|
|
|
|
ফেসবুকে তিনি কংগ্রেস নেতা |
দল বদলের ভূত তাড়া করে কৃষ্ণেন্দুর প্রচারে |
মোনালিসা ঘোষ • ইংরেজবাজার |
বাইরে তৃণমূল নেত্রী। ভিতরে মনমোহন সিংহ, সনিয়া এবং রাহুল গাঁধী। এবং গনি খান চৌধুরী।
ইংরেজবাজারের তৃণমূল প্রার্থী তথা রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর ‘কর্পোরেট অফিস’-এ ঢোকার মুখেই কাট-আউটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভিতরে কাচ-ঢাকা প্রধানমন্ত্রীর মুখ, প্লাস্টার-অফ-প্যারিসের। দেওয়ালে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে ছবিতে গনি, সনিয়ারা। দেওয়ালে তৃণমূলের ছোট্ট ব্যানারের পাশে, কংগ্রেসের নানা ব্যাজ, স্মারক।
মালদহ শহরের কালীতলায় দু’টো বাড়ি জুড়ে এই অফিসে ঢোকার আগে বড় লোহার গেট। সেখানে দাঁড়িয়ে কয়েকজন তৃণমূলকর্মী। অফিসে ঢুকতে গেলে পরিচয় দিতে হবে তাঁদের কাছে। সে পাট মিটিয়ে বাঁ দিকের একতলায় দলীয় কর্মীদের বসার জায়গা। বড় এলসিডি টিভি। নানা আনাচকানাচে মনমোহন-সনিয়া-মমতার ছবিতে সহাবস্থান। দোতলায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের অফিস। ডান দিকের বাড়িটা পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। একতলায় সাজানো অফিস মন্ত্রীর (ভোট-প্রচারে গিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম দেবের মতো মন্ত্রী, সুলতান আহমেদের মতো দলীয় সাংসদেরা বসেছিলেন এখানে)। দোতলায় রয়েছে অতিথিদের জন্য স্যুইট, মাল্টি-জিম। তিন তলায় ডরমিটরি। দলের ছেলেদের জন্য। থাকতে পারেন শ’দেড়েক।
পেটের কাছে নমস্কারের ভঙ্গিতে প্রায় সারাক্ষণ জোড়া হাত। ‘মভ’ রঙা সোয়েটার, আঙুলে পর-পর দামী পাথরের আংটি। দু’টো মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে গালপাট্টা দাড়ি, চোখে চশমার কৃষ্ণেন্দু বললেন, “কেমন দেখছেন আমার অফিস? সব সাজিয়ে রেখেছি। কারও কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।” |
|
কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে। কংগ্রেস যেন আগাপাশতলা জাপ্টে রেখেছে ইংরেজবাজারের পুরপ্রধানকে। পুরনো দল দু’বার ছাড়াটাও লোকে যেন কেমন চোখে দেখছে! মঙ্গলবার স্থানীয় বকখাটুলিতে কৃষ্ণেন্দুবাবুর সভায় আসা জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে শোনা গেল, একাধিক গলা বলছে, “খালি দল বদলাতেই তো সব সময় শেষ। কাম আর করবা কখন?” সে সভায় হাজির তৃণমূলের আর এক মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের (ইনিও কংগ্রেস ছেড়েই তৃণমূলে) ব্যাখ্যা, “কংগ্রেসে থেকে যদি কাজ করা যেত, তা হলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু ওরা কাউকে কাজ করতে দেয় না।”
কাজ করার জন্যই দল বদলেছেন ‘কিষাণদা’ (কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী এলাকায় পরিচিত এ নামেই) তৃণমূল প্রার্থীর অফিস লাগোয়া মাল্টি-জিমে ঢুকতে ঢুকতে দাবি করে গেলেন স্বাস্থ্যবান এক দল যুবক। কৃষ্ণেন্দু বললেন, “শরীরটা তো রাখতে হবে। আমাদের দিদি তো তা-ই বলেন। আমি নিয়মিত শরীর চর্চা করি। তবে জিম দলের ছেলেদের জন্য।” তাঁর সংযোজন, “আমার দলে দরকার তো জোয়ানদের। কোনও বুড়া চাই না। বুড়াদের নিয়ে আমার দলের কোনও লাভ নেই।”
কিন্তু নিম্ন-নিম্ন মধ্যবিত্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের বাস কোতোয়ালি এলাকায় জিপে প্রচারে বেরিয়ে এই কৃষ্ণেন্দুই টেনে আনলেন ‘বুড়া’র কথা। বরকত গনিখান চৌধুরী। মাইকে বলা হল, “বরকতদার করা উন্নতির ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভোটার যন্ত্রে ১ টিপবেন।” বাড়ির দরজায় দাঁড়ানো মহিলা-বৃদ্ধারা বলে ওঠেন, “বরকতদা এক জনই।” দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে থাকা বৃদ্ধদের জটলা থেকে উড়ে আসে, “এতই যদি বুড়ার (গনি খান) ভক্ত, দল বদল করলা কেন্?”
জিপ এগোয়। লিফলেট বিলি চলে। সরু গলির মধ্যে মাটির বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝবয়সী মহিলা তৃণমূল প্রার্থীকে বলেন, “আমাদের জন্য কী কাজ করেছ, তা তো বল!” কৃষ্ণেন্দুর জবাব, “কেন? মাইনরিটি কলেজ করেছি।” জিপে তৃণমূল প্রার্থীর ঠিক পিছনে দাঁড়ানো সাবিনা এগিয়ে আসেন। হরিশ্চন্দ্রপুরের বছর কুড়ির মেয়েটি ভোট-প্রচারে তৃণমূল প্রার্থীর ছায়া-সঙ্গী। বলেন, “কিষাণ জেঠার বানানো কলেজে আমি পড়ছি। উনি অনেক করছেন আমাদের জন্য।”
মাঝবয়সী মহিলা হাসেন। তাঁর হাতে লিফলেট গুঁজে দিয়ে তৃণমূল কর্মীরা বলেন, “আপনি এখানে বলছেন কেন? কিষাণদা মুখোমুখি কথা বলতে ভালবাসেন। যা বলার, ওঁর অফিসে গিয়ে বলবেন।”
তৃণমূল প্রার্থীর অফিসে ফেরার পথে ঝলঝলিয়া মোড়ে চোখে
পড়ে কংগ্রেসের পোস্টার। তাতে ‘মন্ত্রিত্বের লোভে দলত্যাগকারী বিশ্বাসঘাতক’ কে ভোট না দেওয়ার আবেদন। কংগ্রেস প্রার্থী নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারির দাবি, “বরকতদার অবদান জানে মানুষ। ওই বেইমানকে কেউ ভোট দিবে না।” দাড়ি চুলকে কৃষ্ণেন্দু বলেন, “আমি উন্নতি চাই। আর কংগ্রেসে কাজ করা যায় না। তাই এই দলবদল। কে বিশ্বাসঘাতক জানি না।”
তা হলে ‘কর্পোরেট অফিস’-এ এত মনমোহন, সনিয়া কেন? ফেসবুকে মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর ‘পেজ’ খুললেও তো বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, তাঁর দল‘কংগ্রেস’!
এ বার থমকান মন্ত্রী। পরে বলেন, “ওটা তৃণমূলের নয়, আমার অফিস। পছন্দের ছবি, মূর্তি রাখতেই পারি। ওগুলো আমার রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাসের টুকরো।” আর ‘ফেসবুক’? “ওটা ভুল হয়ে গিয়েছে।” |
|
|
|
|
|