|
|
|
|
পঞ্চায়েত কর্মীর কানে কোপ, অভিযুক্ত তৃণমূল |
সুজাউদ্দিন • জলঙ্গি |
একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে মাথা। একেবারে শেষ মুহূর্তে কোনও ক্রমে মুখ সরিয়ে নিতে পেরেছিলেন। ধারালো ছুরির কোপ গিয়ে তখন পড়ে বাঁ কানে। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির দেবীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাহী সহায়ক হজরত ওমরের সেই কান কেটে গিয়েছে।
অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। সিপিএমের জলঙ্গি জোনাল কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক এবং জেলা কৃষক সভার বর্তমান সম্পাদক আবু বক্করের ভাই হজরত ওমর বলেন, “তৃণমূলের কয়েক জন কর্মী বৃহস্পতিবার পঞ্চায়েত দফতরে ঢুকে আমাকে মারধর করেছে। আমার মুখ লক্ষ্য করেই একজন ছুরি চালিয়ে দেয়। কোনও মতে মুখটা সরিয়ে নিতে পারলেও কান কেটে গিয়েছে।” অভিযুক্তেরা নিজেরাও ওই ঘটনার সময় নিজেদের তৃণমূল কর্মী বলে পরিচয় দেন। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য দাবি করেছেন, এই ঘটনায় তাঁদের কেউ জড়িত নন।
বুধ ও বৃহস্পতিবার পরপর দু’দিন সিটু-সহ বিভিন্ন বাম শ্রমিক সংগঠনের ডাকা ধর্মঘট ছিল। এর মধ্যে বুধবার এই গ্রাম পঞ্চায়েত দফতর বন্ধ ছিল। তবে এ দিন দফতর খুলে প্রায় সব কর্মীই হাজিরা দেন। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ হঠাৎ ঢুকে পড়ে আট-দশ জন যুবক হজরত ওমরকে মারধর শুরু করেন। বুধবার দফতর কেন খোলা হয়নি তার জবাবদিহি চাইতে থাকেন তাঁরা। সেই সঙ্গে চলে অশ্রাব্য গালিগালাজ। তাঁরা দাবি করতে থাকেন, ধর্মঘটকে সমর্থন করেই বুধবার দফতর খোলা হয়নি। হজরত ওমরের সহকর্মী পঞ্চায়েত কর্মী আব্দুল কুদ্দুস ঘটনার সময়ে ওই ঘরেই ছিলেন। তিনি জানান, আচমকা ওই যুবকেরা চড়াও হওয়ায় সকলেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা বাধা দেব কী, ভয়েই কোণঠাসা হয়ে পড়ি। ওই যুবকদের মারমুখী চেহারা, হাতে ছুরি। তাঁদের লক্ষ্য ছিলেন হজরতই। ওই যুবকেরা তাঁকেই মারধর করবে বলে ঢুকেছিল। ছুরির ঘায়ে হজরতের কান কেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল। তাই দেখেই ওই যুবকেরা পালিয়ে যান।” |
চিকিৎসা চলছে জখম হজরত ওমরের। ছবি: গৌতম প্রামাণিক |
অভিযুক্ত যুবকদের প্রায় সকলেই সীমান্তবর্তী ওই এলাকারই বাসিন্দা। কংগ্রেস ও বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ওই পঞ্চায়েতের প্রধান বিজেপি-র জিতেশ প্রামাণিক বলেন, “ওই যুবকেরা সকলেই এখন তৃণমূল কর্মী-সমর্থক। তবে বেশিরভাগই সমাজবিরোধী।”
হজরত ওমর থানায় বাবলু শেখ, লিটন শেখ, সামসুদ্দিন মোল্লা, পিন্টু শেখ, রেজ্জাক শেখ এবং আব্দুস সালামের নামে অভিযোগ করেছেন। এঁদের মধ্যে রেজ্জাক শেখ এ দিনই গ্রেফতার হয়েছে। বাকিরা পলাতক। জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা, ধারালো অস্ত্র দিয়ে গুরুতর আঘাত এবং সরকারি দফতরে ঢুকে হামলার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।” জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুশি করতে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে পেশিশক্তির প্রতিযোগিতা চলছে। আগামী দিন এমন ঘটনা আরও বাড়বে।”
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, “ওই ঘটনায় তৃণমূলের কেউ জড়িত নন।” তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন হজরত ওমরকে পঞ্চায়েতের ‘প্রধান’ বলেছেন। এই দিন দিল্লিতে তিনি পার্থবাবুর সুরেই বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে এক জন প্রধান অফিসে যাননি। কাজ হচ্ছে না বলে ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় মানুষ তাঁর উপর চড়াও হন। এর সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই।” ডেরেকের বক্তব্য, “এই ২৪ ঘণ্টার সংবাদমাধ্যমের যুগে গুজব খুব দ্রুত ছড়ায়। কারও কান কাটা যায়নি। কোনও তৃণমূল কর্মী কাউকে আক্রমণ করেননি। আমাদের বিরোধীরা কি নোংরা কৌশল থেকে বিরত থাকতে পারেন না?” তবে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এবং ডেরেক ঘটনাস্থলে লোক পাঠিয়েছেন প্রকৃত ঘটনা সরেজমিনে দেখে আসার জন্য।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি মহম্মদ আলির দাবি, “ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্যই ওই ব্যক্তিকে মারধর করা হয়েছে। সেই সময়ে তিনি পড়ে গেলে গ্রিলে লেগে কান কেটে যায়।” তিনি জানান, রানিনগর ঘেঁষা জলঙ্গির ওই গ্রাম ও তার আশপাশের এলাকায় তৃণমূলের তেমন কোনও প্রভাবই নেই। হজরত ওমরের দাদা আবু বক্কর অবশ্য মনে করেন, ব্যক্তিগত শত্রুতার কোনও প্রশ্নই নেই, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্যই আক্রান্ত হয়েছেন হজরত। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এই ঘটনাকে ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর কথায়, “যাঁদের দু’কান কাটা, তাঁরা অন্যদের দু’টো কান স্বস্থানে থাকুক, তা সহ্য করতে পারছে না!”
বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুরও অভিযোগ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর প্ররোচনামূলক বক্তব্য (ধর্মঘট নিয়ে) এই আক্রমণকে মদত জোগাচ্ছে।” কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়াও ওই ঘটনার কড়া নিন্দা করেন। তাঁর দাবি, মুখ্যমন্ত্রীকে সরকারি কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। নেত্রীর নির্দেশেই কি তৃণমূল কর্মীরা এমন কাণ্ড ঘটাচ্ছেন? মানসবাবুর জবাব, “গ্রামে, গ্রামে হাজার-হাজার দলীয় কর্মী রয়েছেন। তাঁরা সব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ মানছেন কি না, এ ধরনের ঘটনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গর্বিত কি না, সেটা আমি কী করে বলব?” |
|
|
|
|
|