|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
পরিবর্তন |
যে কোনও ভারত বন্ধই যে প্রকৃত প্রস্তাবে সর্বাত্মক বাংলা বন্ধে পরিণত হইবে, ইহা কিছু দিন আগেও এক রকম স্বতঃসিদ্ধ ছিল। বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা দুই দিনের সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট সেই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী। বেঙ্গালুরু বা মুম্বইয়ের ন্যায় শহর, যেখানে কোনও বন্ধই তেমন দাগ কাটিতে পারে না, সেখানেও এই বন্ধ অন্তত আংশিক ভাবে সফল হইয়াছে। লখনউ বা ভুবনেশ্বরেও। কেন, তাহা পৃথক প্রশ্ন। আপাতত লক্ষণীয়, যে শহর বা রাজ্যগুলিতে বন্ধ বেশ রকম সফল, সেই তালিকার শীর্ষে কলিকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের নাম নাই। স্মরণকালের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে নাই। কেহ বলিতেই পারেন, মুখ্যমন্ত্রী বন্ধের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়াতেই পশ্চিমবঙ্গের ছবিটি বদলাইয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছায় না হয় সরকারি অফিসে কর্মীরা হাজির হইয়াছেন কিন্তু কেবলমাত্র তাঁহার কথা শুনিয়াই রাজ্যবাসী বন্ধ ব্যর্থ করিয়া দিলেন, এমন অনুমান করা ভুল হইবে। মুখ্যমন্ত্রী যাহাই ভাবুন, তাঁহার তেমন দাপট নাই।
ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা ধর্মঘট দেশের ধর্মঘট-রাজধানীতেই কেন কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ হইল, সেই প্রশ্নের উত্তর হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে নাই, আছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। বন্ধ ব্যর্থ, কারণ সিপিআইএম তাহাকে সফল করিবার চেষ্টা করে নাই। কেন, তাহার একটি তত্ত্ব এই রূপ: বন্ধ সফল করিবার সামর্থ্য তাহাদের নাই। যুক্তিটি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য নয়। শক্তি বুঝিয়া কাজ করিবার অভ্যাস বামপন্থীদের কোনও দিনই নাই, আর তা ছাড়া জনজীবন অচল করিবার নেতিবাচক শক্তি তাঁহাদের অন্তর্হিত হইয়াছে, এমন কথাও মানিয়া লওয়া কঠিন। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট যে এই বন্ধ সফল করিতে গা করিল না, তাহার একটি প্রধান কারণ এক ব্যক্তির মানসজগতে খুঁজিতে হইবে। তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁহার বন্ধ-বিরোধী অবস্থান সর্বজনবিদিত। এই ধর্মঘটেও তিনি তাঁহার আপত্তি প্রকাশ করিয়াছিলেন, এবং অনেকাংশে তাঁহার ও তাঁহার সমমতাবলম্বীদের আপত্তিতেই গোটা দেশে ৪৮ ঘণ্টার হইলেও পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ ২৪ ঘণ্টার হইয়াছে। তিনি বন্ধটি প্রত্যাহার করাইতে পারেন নাই বটে, কিন্তু নিজের মতটিকে দলের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছেন। সিপিআইএম এই বন্ধে নিশ্চেষ্ট থাকিয়াছে। বুদ্ধদেববাবু রাজ্যের মানুষের নাড়ি টের পাইয়াছেন কর্মনাশা ধর্মঘট যে তাঁহাদের রাজনীতির সহায়ক হইতেছে না, তিনি বুঝিয়াছেন। তাৎপর্যপূর্ণ হইল, তিনি এই দফায় দলকে, অন্তত দলের একটি বড় অংশকে, সঙ্গে পাইয়াছেন। পলিটব্যুরো নামক গজদন্তমিনারে বসিয়া যে রাজনীতি হয় না, এই কথাটি দলের অভ্যন্তরে ধ্বনিত হইয়াছে। তাহার মূল কারিগর বুদ্ধদেববাবু। বাস্তবের বিচিত্র মহিমা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একই অবস্থানে। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে অতি সুসংবাদ।
তবে কি বন্ধ-বিরোধী এই অবস্থান বুদ্ধদেববাবুর ব্যক্তিগত? সেই সম্ভাবনা কম। তিনি এই অবস্থানের মূল প্রবক্তা বটে, কিন্তু আলিমুদ্দিনের অভ্যন্তরে একটি বড় অংশ একমত না হইলে একা বুদ্ধদেববাবু বন্ধ ব্যর্থ করিতে পারিতেন না। অর্থাৎ, সিপিআইএম-এর মধ্যে একটি নীতিগত পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট। সেই পরিবর্তন পূর্ণ রূপে বিকশিত হইতে পারিবে, না কি দল ফের পুরাতন পথেই ফিরিয়া যাইবে, সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে আপাতত সম্ভাবনাটি সত্য। বড় পরিবর্তন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম বার কমিউনিস্ট পার্টি তাহার ট্রেড ইউনিয়নের সহিত শ্যামদেশীয় যমজের ন্যায় থাকিতে অস্বীকার করিতেছে। দেশের প্রায় সব প্রধান রাজনৈতিক দলেরই শ্রমিক সংগঠন আছে। কিন্তু অবিভক্ত সিপিআই-এর আমল হইতে এখনও পর্যন্ত বামপন্থী দলের নেতারা যেমন সক্রিয় ভাবে ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন, তাহা ভারতে আর কোনও দলই করে না। অতীতে বামপন্থীদের কিছু তাত্ত্বিক বাধ্যবাধকতার কারণে এই কাজটি করিতে হইত, তাহার পর অভ্যাসে। সেই অভ্যাসটি কাটাইয়া তাঁহারা যে সত্যই একটি আধুনিক দলের ন্যায় ভাবিতে চেষ্টা করিতেছেন, ইহা তাঁহাদের পক্ষে সুসংবাদ। তবে, এখনও পর্যন্ত এই পরিবর্তন সম্ভাবনামাত্র। তাহাকে তাহার যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছাইয়া দেওয়ার দায়িত্ব বুদ্ধদেববাবুদেরই। |
|
|
|
|
|