|
|
|
|
হুল্লোড় |
হিট গান মানেই ভাল গান নয় |
তাঁর হাত ধরে বাঙালি সুরকারদের বলিউডে আবার সুদিন ফিরছে। তবু প্রতিষ্ঠিত বাঙালি গায়কদের
অভিমান যে তাঁরা প্রীতম-এর সুরের রাজ্যে ব্রাত্য। কেন? শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
|
খুব ধুমধাম করে তো সরস্বতী পুজো করলেন এ বার। প্রিয়ঙ্কা চোপড়া নাচলেন আপনাদের পুজোতে। নিজের জন্য কী চাইলেন?
এ বার পুজো নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে চাইতেই ভুলে গিয়েছি কিছু। সাধারণত আমি চাই ছবিতে ভাল গানের ঝুলিটা যেন সব সময় ভর্তি থাকে, যাতে শ্রোতারা খুশি থাকেন।
ঠাকুরকে একবারও বলেননি যে ‘যাক, আমার বিরুদ্ধে আর পুরোনো অভিযোগগুলো আনা হচ্ছে না’?
আবার বিতর্ক? ছাড়ুন না। ঠাকুরের কাছে এই সব কেন বলতে যাব?
অস্কার বিজয়ী একজন পরিচালক আপনাকে বলছেন তাঁর সিনেমায় সুর দিতে। এটাই কি সমালোচকদের জন্য আপনার জুতসই জবাব নয়?
জীবনে অনেক দেখেছি। আজ অত ভাবি না। ড্যানিশ ট্যানোভিক ছবিটির পরিচালক। উনি ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ ছবিটি বানিয়েছেন। এখন ভারতে ইমরান হাসমিকে নিয়ে ছবি করছেন। গুণিত মোঙ্গিয়া ছবিটির প্রযোজক। ড্যানিশ অনেক হিন্দি ছবির গান শুনেছিলেন। আমার ‘ক্যায়সে বতায়ে’ শুনে ওঁর মনে হয়েছিল যে আমি ঠিকমতো ছবিটার সুর দিতে পারব। কাকে জুতসই জবাব দিচ্ছি বা না দিচ্ছি তা নিয়ে চিন্তিত নই। সে ভাবে দেখতে গেলে তো ‘এশিয়া প্যাসিফিক ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস’-এ ভারতীয় সুরকার হিসেবে আমারই একমাত্র ছবি মনোনীত হয়েছিল। পুরস্কারটা জিতেছিলাম ‘বরফি’-র জন্য। তবে এই নিয়ে অত মাথা না ঘামানোই ভাল। এখন বুঝি যে, কিছু সংখ্যক মানুষ আছেন যাঁরা আমার গান সত্যিই পছন্দ করেন। আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় হল তাঁদের মতকে গুরুত্ব দেওয়া।
|
|
প্রীতমের সুর দেওয়া ‘বরফি’ ছবির একটি দৃশ্যে প্রিয়ঙ্কা চোপড়া এবং রণবীর কপূর
|
‘পিপলস চয়েস’ অ্যাওয়ার্ড পাওয়াটা তো অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আপনার। ‘বরফি’-ই সব বদলে দিল। এতগুলো চার্টবাস্টারে সুর দিয়েও, পুরস্কারটা কি বিশাল কিছু বদলে দিয়েছে আপনার জীবন?
আমাদের দেশে পুরস্কার পেলেই যে কেরিয়ারে বিশাল পার্থক্য হয়ে যায় তা কিন্তু নয়। মা’র জন্য একটা ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেতে হতই। উপোস করতেন যাতে আমি একদিন এই সম্মানটা পাই। খারাপ লাগত দশটা মনোনয়ন পেয়েও শেষমেশ পুরস্কারটা ফসকে যেত যখন। মাকে খুশি করতে পারাটাই আমার কাছে একটা পরিবর্তন।
আপনার হাত ধরে বাঙালি সুরকারদের তো বলিউডে আবার রমরমা। তবুও শান, বাবুল, অভিজৎদের বলিউডে তেমন সুযোগ দিচ্ছেন না কেন?
কেন? আমি তো অরিজিৎ সিংহ, মোনালি ঠাকুর, অন্তরা মিত্র, সোহম চক্রবর্তীকে দিয়ে গাইয়েছি। তা হলে এ কথা উঠছে কেন? নতুন বাঙালি গায়কদের সুযোগ দেওয়াটা কি ধর্তব্যের মধ্যে আসে না? আরও নতুন বাঙালি গায়ক রয়েছে। আমার খুব আনন্দ হবে যদি আমি শান আর বাবুলকে দিয়ে ভাল গান গাওয়াতে পারি।
আর অভিজিৎ?
অভিজিৎদাও আমার গান গেয়েছে।
কবে শেষ গেয়েছেন আপনার সুরে?
(ভেবে) হ্যাঁ, অনেক দিন হল।
এত গ্যাপ কেন? নতুন বাঙালি গায়ক খোঁজাটা কি বেশি আনন্দদায়ক?
না না, তা কেন হবে? অভিজিৎদা তো আমার অনেক গান গেয়েছে। শানুদা তো একটাও গাননি। আচ্ছা, আপনার কি রাগাতে ভাল লাগে?
রাগাব কেন? এটা তো অনেকের ধারণা যে, নতুন বাঙালি গায়কদের প্রীতম ছবিতে সুযোগ দেন আর পুরনো গায়কদের সুযোগ দেবেন বলে সাক্ষাৎকারে প্রতিশ্রুতি দেন...
নতুন গায়ক বা নতুন কণ্ঠস্বরের প্রতি আলাদা করে আমার কোনও আকর্ষণ নেই। যদি না এ ভাবে বলি যে নতুনকে আমার স্বাগত জানাতে ভাল লাগে। আসলে আমি যখন কোনও গান বাঁধি, সেটা কাউকে দিয়ে গাওয়ানোর পর আমি দেখে নিই ওই গলাটা ওই গানটার পক্ষে ঠিক কি না। অনেক ভেবে যাকে ডাকা হল সে হয়তো গানটার কালারটা ঠিক দিতে পারল না। নতুন কেউ হলে তাকে খুব সহজেই বলা যায় যে, গানটা ওর গলাতে মানাচ্ছে না। কিন্তু যারা অনেক দিন ধরে গাইছে তাদেরকে এই কথা বলাটা একটু কঠিন। তাই যারা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত, তাদের অনেক ভেবেচিন্তে ডাকি। সেই তুলনায় নতুনদের দিয়ে আমি অনেক সহজেই গানটা তোলাতে শুরু করতে পারি। বলা বাহুল্য অনেক নতুনেরা চমকে দেওয়ার মতো ভাল গান গেয়েছে।
আপনিই বলেছিলেন আগেকার দিনে যদিও গায়করা বেশি প্রভাবশালী ছিলেন, এখন সঙ্গীত পরিচালকরা সেই জায়গাটা নিয়ে নিয়েছেন। এটা কি ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভাল না খারাপ?
ভাল খারাপ বলতে পারব না। তবে এটাই সত্যি। আগে গায়কদের কথায় ইন্ডাস্ট্রি অনেকটাই চলত। এখন সঙ্গীত পরিচালকদের কথাটার জোর বেশি। তারাই তো গানটা বানায়। তাই তাদের কথার দাম থাকা দরকার।
আপনি বনি চক্রবর্তীকে দিয়ে ‘পৃথিবী’ গানটা হিন্দিতে গাওয়াতে চেয়েছিলেন ‘গ্যাংস্টার’ ছবিতে। কিন্তু প্রযোজক জেমসকে দিয়ে ‘ভিগি ভিগি’ গাইয়েছিলেন। পছন্দের গায়কদের দিয়ে গাওয়ানোর ব্যাপারে এখন কতটা সফল আপনি?
এখন আমার মতের দাম আছে। যখন নিজে খুব নিশ্চিত থাকি না, আমি প্রযোজক- পরিচালকদের মতটা নিই। কিন্তু আমি যখন নিশ্চিত থাকি, কারও কথা শুনি না। তখন আমার ফেভারিট লাইন হল ‘এক চুলও যদি কিছু পাল্টাতে চান তা হলে খুনোখুনি হয়ে যাবে। ইউ হ্যাভ টু গো ওভার মাই ডেডবডি।’ এটা শুনে কেউ আর কিছু পাল্টাতে বলে না।
আজকাল তো সঙ্গীত পরিচালকরা ভাল গানগুলো নিজেদের জন্য রেখে দেন বলে গায়করাও বেশ অসন্তুষ্ট...
সুরকারেরা যদি নিজেরাই গান করে, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। গানটা তো তাদেরই সৃষ্টি। সারা বিশ্বে সুরকারেরা নিজেরাই নিজেদের গান গেয়ে থাকে। এত অভিযোগ না করে গায়কেরা নিজেরাই তো সুর দিতে পারে।
ভাল গান আর হিট গান দু’টো আলাদা জিনিস। আপনার কোন কোন ভাল গান কোনও দিন হিট হয়নি বলে
মনে হয়?
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিট গান মানেই ভাল গান হবে তার কোনও মানে নেই। ছবির প্রচারের সময় আম জনতার চাহিদা মাথায় রেখে গান প্রোমোট করা হয়। সে ক্ষেত্রে ভাল গানগুলো হারিয়ে যায়। ‘বরফি’ থেকে ‘ফির লিয়া দিল’ গানটাই দেখুন। আমি ভেবেছিলাম গানটা আরও বেশি জনপ্রিয় হবে। ‘অগ্নিপথ’এর ‘অভি মুঝমে বাকি হ্যায়’ ‘চিকনি চামেলি’-র থেকে অনেক বেশি ভাল গান। কিন্তু জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ‘চিকনি চামেলি’ এগিয়ে।
আপনাকে কি কেউ বলেছেন ‘যা ইচ্ছে করুন, শুধু একটা হিট চাই আমার’?
(হাসতে হাসতে) ইন্ডাস্ট্রিতে তো সব সময় সবাই চায় হিট গান। এ আর নতুন কী! অনুরাগ বসু অবশ্য ব্যতিক্রম। ওর পেটেন্ট ডায়লগ ছিল ‘আমার হিট গান চাই না।’ একটা গানে সুর দিয়ে কত বেশি রোজগার করব এটাকে আমি গুরুত্ব দিই না। আমার দোষ হল যে আমি না বলতে শিখিনি। তাই অনেক কাজ একসঙ্গে নিয়ে মাঝে মধ্যে হিমশিম খাই। এখন একটা অন্য কায়দায় চলছি। জুন অবধি নতুন কোনও ছবি নেব না। তাও হাতে আটটা ছবি।
|
প্রীতমের মতে |
শান্তনু মৈত্র
সুরের মধ্যে একটা স্বতঃস্ফূর্ত মিষ্টতা রয়েছে। ‘বরফি’র
সময় আমার মনে হয়েছিল এটা ওর ধরনের ছবি। |
অনুপম রায়
যে ভাবে ও গানকে অ্যাপ্রোচ করে, সেই রাস্তাটা
একেবারে অন্য ধরনের। গানের কথা লিখতে খুব দক্ষ। |
|
জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
ও কমপ্লিট প্যাকেজ। সৃজনশীল গানে যেমন ভাল,
ঠিক
তেমনই ভাল দেবের হিট
নাচের গানে। |
ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত
ওর সুরে কৌশিকীর গান ভাল লাগে। ওর ‘বোঝে না সে
বোঝে না’ গানটায় পরিণত সুরকারের ছাপ আছে। |
|
কাজ ছেড়ে দিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তার সঙ্গে কী ভাবে মানিয়ে নেন?
আমি ভীষণ অগোছালো। টাইম ম্যানেজমেন্টটা এখনও শিখিনি। তবে এখন বুঝি, কাউকে না বলে যে কটূ কথা শুনতে হতে পারে তার থেকে অনেক বেশি দুঃখ হবে বেশি কাজ নিয়ে ভাল সুর না দিতে পারলে।
এমন কেউ আছেন যাঁর ছবি কোনও দিন ছাড়বেন না?
অনুরাগ। আমার অতীতের কর্মফল, যে আমার সঙ্গে অনুরাগ ও তাঁর স্ত্রী তানির আলাপ রয়েছে। অনুরাগ শুধু মাত্র ভাল পরিচালক নয়। ও ভাল মানুষ। ওকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি।
‘বরফি’-র সম্পর্কে অনুকরণের অভিযোগ এলেও আপনার গানগুলো নিয়ে কোথাও কোনও অভিযোগ শোনা যায়নি এখনও। এতে কি আপনার অহং তৃপ্ত হয়?
(হেসে) উফফ্ বাজে প্রশ্ন। পাস।
অ্যাওয়ার্ড সেরিমনিতে আজকাল শাহরুখ খান সারাক্ষণ আপনার চুল নিয়ে ঠাট্টা করেন।
হেয়ারস্টাইলের টিপস নেন না কেন ওঁর থেকে?
শাহরুখ আমার খুব প্রিয় মানুষ। রসিকতাবোধ অসাধারণ। চুলটা লম্বা রাখার কারণটাই হল যাতে কোনও হেয়ারস্টাইল করে সময় নষ্ট না করতে হয়। তাই শাহরুখের কাছ থেকে হেয়ারস্টাইলের টিপস নিয়ে সে অর্থে কোনও লাভ নেই আমার।
আপনার রাতগুলো তো সব প্রযোজকরাই নিয়ে নিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা কত বড় হয়েছে সেটা বোঝাতে গেলে কি ওদের উচ্চতাটা ইঞ্চি মেপে দেখান, না কি শুয়ে থাকা অবস্থায় কত লম্বা লাগে সেটা বলেন?
(হেসে) আমি রাতে কাজ করি। দিনে ঘুমাই। বাড়ি থেকেও কাজ করি। তাই স্কুল থেকে ফিরে এলে ঘুমচোখে হলেও ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়।
আজকাল প্রতিযোগিতা বলতে ঠিক কী মনে করেন? দয়া করে বলবেন না আপনার প্রতিযোগী আপনি নিজেই।
একটু প্রতিযোগিতার মানসিকতা থাকা দরকার নিজের উন্নতির জন্য। সে দিক থেকে সবাই আমার প্রতিযোগী।
এক দিকে হিট গানের চাহিদা। আর অন্য দিকে নিজস্ব শিল্প সৃষ্টির ইচ্ছে। এ সব সামলে চলেন কী করে?
শ্রোতাদের রুচি নানা ধরনের। আমজনতার কথা ভেবে গান বানালে সমালোচকেরা বলবেন জাত গেল। যদি সৃষ্টিশীল কাজ করি তা হলে সেটা হিট নাও হতে পারে। এই ভারসাম্যটা রাখাই আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলা ছবির সুর দিতে কত দেরি?
এ বছর হবে না। সত্যি বলতে কী, সৃজনশীল কোনও বাংলা ছবির অফার আমার কাছে বহু কালই আসে না। |
|
|
|
|
|