|
|
|
|
ছুটির টান কি কাটাবে বাঙালি |
প্রশাসনের আশ্বাস, তবু সঙ্গী সংশয় |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
আজ, বুধবার বাঙালির অগ্নিপরীক্ষা!
বাম দলগুলির বনধের ডাক ব্যর্থ করে বাঙালি কি আজ অন্য দিনের মতোই কাজে বেরোবে, নাকি জনজীবন স্বাভাবিক রাখার যাবতীয় সরকারি বন্দোবস্ত এবং প্রশাসনিক আশ্বাস সত্ত্বেও বাড়ি বসে একটি বাড়তি ছুটি কাটাবে? অভিজ্ঞতা বলে, যে কোনও অছিলায় ছুটি খুঁজে নেওয়াই বাঙালির অভ্যস্ত ‘কর্মসংস্কৃতি’। যে কোনও বনধের ডাকেই সেই ‘সুযোগ’ মেলে।
সম্প্রতি বনধ সংক্রান্ত একটি মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ কুমার মিশ্রও দায়ী করেছেন বাঙালির ছুটি-সংস্কৃতিকেই। তাঁর মন্তব্য ছিল, “হাইকোর্টের নির্দেশে কর্মসংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা যায় না। বিষয়টা মানুষের অন্তর থেকে আসতে হয়। অন্তর সায় না দিলে কাজ করার সংস্কৃতি আসে না।”
বনধ রুখতে রাজ্য সরকার অবশ্য কড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রস্তুতি নিয়েছে। বুধবার থেকে শুরু হওয়া ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট মোকাবিলার পন্থা খুঁজতে মঙ্গলবার দুপুরে মহাকরণে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে গঠিত টাস্কফোর্সের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিব। পাশাপাশি রয়েছে কাজে যোগ দিতে ইচ্ছুকদের সেই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের কড়া নির্দেশিকা। সরকার জানিয়েছে, বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি সব চলবে বুধবার। চলবে ফেরি, মেট্রো। বিমান চলাচলও স্বাভাবিক থাকবে বলে জানানো হয়েছে। বাস, ট্যাক্সি না নামালে লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী। দোকানদারদের দোকান খোলার আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। কলকাতার মেয়র বলেছেন, দোকান বন্ধ রাখা হলে তার ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হবে। |
আজ বনধ। তাই মঙ্গলবার মহাকরণেই নিশিযাপন। ছবি: সুমন বল্লভ |
আদালত-স্কুল-কলেজকে জরুরি পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। বনধে কোনও সম্পত্তির ক্ষতি হলে দায়ী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলকে মোটা জরিমানা দিতে হবে বলেও হাইকোর্ট জানিয়ে দিয়েছে। বনধের দিন রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের কোনও ছুটি মঞ্জুর করা হবে না বলে নির্দেশিকা জারি করেছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব। অর্থাৎ বুধবার কেউ না এলে তাঁর এক দিনের বেতন কাটা যাবে। বনধ ব্যর্থ করতে মুখ্যমন্ত্রীকে দিতে হয়েছে পরবর্তী কোনও সময়ে ছুটির টোপ। কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় জানান, অন্য বারের মতো এ বারও বনধের দিন কর্মীদের হাজিরা বাধ্যতামূলক (আগাম না জানিয়ে) করা হচ্ছে। অনুপস্থিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মী বা অফিসারের বেতন কাটা যাবে। ব্রেক অফ সার্ভিসও হবে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও শেষ পর্যন্ত ছবিটা কী দাঁড়াবে, মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত তা স্পষ্ট নয়। সরকারি চাকরির মতো যে সব ক্ষেত্রে কাজে যোগ দেওয়ার ‘চাপ’ বেশি, সেখানে বনধ না-মানার কিছুটা বাধ্যবাধকতা আছে। মহাকরণ, বিকাশ ভবন-সহ কিছু সরকারি অফিসে কর্মীদের একাংশ রেঁধে-খেয়ে রাত কাটানোর ব্যবস্থাও করেছেন। তবে সংখ্যার বিচারে তা নগণ্য। মূল হাজিরা বোঝা যাবে আজ সকালে।
ক্লাস করানোর ঝুঁকি নিচ্ছে না সিংহভাগ বেসরকারি স্কুল। কোথাও সরাসরি ছুটি ঘোষণা হয়েছে, কোথাও পরীক্ষা বাতিল হয়েছে, কোথাও আবার ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো, না-পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাড়ির লোকের উপরেই ছাড়া হয়েছে। কিন্তু আজ, বুধবার দেশজোড়া ধর্মঘটের দিনে স্কুল যে হবে না, সে ব্যাপারে একমত স্কুল-প্রধানদের প্রায় সকলেই। সরকারি, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল-কলেজে সরাসরি ছুটি ঘোষণা করার সুযোগ নেই। কারণ, সরকারি নির্দেশে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেই হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু সেখানেও ক্লাস হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই গিয়েছে। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু মঙ্গলবারও জানিয়েছেন, স্কুল-কলেজ সব খোলা থাকবে। সবাইকে আসতে হবে। |
বনধ মোকাবিলায় |
প্রশাসনিক স্তরে |
• সরকারি কর্মীদের ছুটি মঞ্জুর নয়
• দোকান বন্ধ রাখলে কড়া ব্যবস্থা
• বাজারে পুলিশ প্রহরা
• দোকান ভাঙচুর হলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ, আশ্বাস রাজ্যের
• বাস-ট্যাক্সি না নামালে বাতিল হতে পারে লাইসেন্স
• বাস-ট্যাক্সির ক্ষতি হলে সরকারি বিমা
সংস্থার সাহায্য, আশ্বাস রাজ্যের
• বাসের চালক ও কন্ডাক্টরদের আনতে বাস
• বিমান, রেল, মেট্রো চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা
• প্রতি ডিপোয় অতিরিক্ত ৪০-৫০টি বাস
• স্পর্শকাতর এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ |
রাজনৈতিক স্তরে |
• তৃণমূল ভবনে ‘কন্ট্রোল রুম’ আইএনটিটিইউসি-র
• কাজে বাধা পেলে যোগাযোগ
কন্ট্রোল রুমে
• কোনও রকম সংঘাতে না যেতে কর্মীদের নির্দেশ তৃণমূলের |
|
তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও একটু ঢিলেঢালা মনোভাব। সকালের শিফ্টে কিছু কর্মী যাতে থাকেন, তেমন ব্যবস্থা করেছে বেশ কয়েকটি সংস্থা। তবে আজ হাজিরার সমস্যা হলে বিকল্প কাজের দিন হিসেবে আগামী শনিবার অফিস চালু রাখার একটি সংস্থানও অনেকে রাখছেন।
বিমান চালু রাখার জন্য ঠিক হয়েছে, কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন বিমানসংস্থার কর্মী, সেবিকা ও পাইলটেরা একসঙ্গে কনভয় করে শহর থেকে যাতায়াত করবেন। কোনও সংস্থার সেবিকা ও পাইলটেরা অন্য শহর থেকে এসে আগে বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলে তাঁরা অন্য সংস্থার সেবিকা ও পাইলটদের জন্য অপেক্ষা করবেন। একসঙ্গে অনেকে জড়ো হলে তবে পুলিশ-পাহারায় শহরে যাবেন তাঁরা। একই ভাবে শহর থেকে একজোট হয়ে তাঁরা বিমানবন্দরে আসবেন। সেই ভাবে উড়ানসূচিরও সামান্য হেরফের করা হয়েছে বলে বিমানবন্দর সূত্রে জানা গিয়েছে।
‘ফোরাম অফ ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ কোলে বলেন, “কলকাতা পুরসভার ৪৬টি বাজার বুধবার খোলা থাকবে। প্রত্যেক জেলায় সব পুর-মার্কেট খোলা থাকছে। বাজারগুলিতে পুলিশ প্রহরা থাকবে। হকার্স ইউনিয়নগুলিকেও বলেছি সব খোলা রাখতে। বনধ সমর্থকেরা দোকান ভাঙচুর করলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ দেবে সরকার। কত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সেটা পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা ঠিক করব। আর কেউ বনধের জন্য দোকান বন্ধ রাখলে সরকার কড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে বলে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী নিজে জানিয়েছেন।” তাঁর কথায়, “পাগলও নিজের ভাল বোঝে, ব্যবসায়ীরা তো বুঝবেনই।”
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র এ দিন মহাকরণে বলেন, “একমাত্র লরি ও ট্যাঙ্কার বাদ দিয়ে সমস্ত যানবাহনের মালিক সংগঠনগুলিকে আলোচনায় ডাকা হয়েছিল। তাঁদের বুঝিয়েছি, এই ধর্মঘটে তাঁদের সমস্যার সমাধান হওয়ার নয়। আমরা আলোচনা করে দ্রুত সব সমস্যা মিটিয়ে দেব। যাঁরা গাড়ি চালাবেন না তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা মুখ্যসচিবের সার্কুলারেই বলা আছে। তা কঠোর ভাবে প্রয়োগ হবে।”
মন্ত্রী জানান, যে হেতু বাস চলে মূলত ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরের সাহায্যে তাই শ্রমিক সংগঠনগুলিকেও তাঁরা বুঝিয়েছেন। সংগঠনগুলিও বলেছে, নীতিগত ভাবে তারা বনধে গাড়ি চালাতেই আগ্রহী। শিয়ালদহ, হাওড়া, বড়বাজারের মতো কিছু জায়গাকে স্পর্শকাতর হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশি প্রহরা থাকবে বলেও মন্ত্রী জানান। পরিবহণ দফতর সূত্রে খবর, স্কুল খোলা থাকলে স্কুলবাসও চলবে। তা ছাড়া, নিত্যযাত্রীদের যাতে কোনও অসুবিধা না-হয় তার জন্য একাধিক ভলভো বাস রাস্তায় নামবে। বাসের চালক ও ড্রাইভারদের বাড়ি থেকে আনা-নেওয়ার জন্যও বিশেষ ভলভো বাস চালানো হবে। প্রত্যেক ডিপোয় অতিরিক্ত ৪০-৫০টি করে বাস রাখা হবে। |
বন্ধের সমর্থনে ধর্মতলায় মিছিল। —নিজস্ব চিত্র |
মালিক পক্ষ, বিশেষ করে ট্যাক্সিমালিকদের আশঙ্কা ছিল যে, ধর্মঘটের দিন গাড়ি চালালে গাড়ি ভাঙচুর হতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা এ দিন পরিবহণমন্ত্রীকে জানান, বনধ সমর্থকেরা গাড়ি ভাঙলে বিমা সংস্থাগুলি টাকা দিতে চায় না। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ দিন মহাকরণে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকও করেন পরিবহণমন্ত্রী। পরে তিনি দাবি করেন, “যে সব গাড়ির কম্প্রিহেনসিভ পলিসি আছে, সাধারণ ধর্মঘটে ওই সব গাড়ি ভাঙচুর হলে ক্ষতিপূরণ মিলবে।” তিনি বলেন, “সরকার বনধের বিরোধী। যাঁরা এ দিন পথে গাড়ি নামাবেন তাঁরা সরকারের ওই অবস্থানকেই সমর্থন করছেন। তাই সরকারি বিমা সংস্থাগুলি তাঁদের সাহায্য করবে।”
এ দিন জয়েন্ট কাউন্সিল অফ লাক্সারি ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন-এর সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর ঘোষ জানান, তাঁরা সরকারের কাছে বর্ধিত ভাড়ার আবেদন করেছিলেন । সরকার তাঁদের শর্ত মেনে নিয়েছে বলে বুধবার লাক্সারি ট্যাক্সি রাস্তায় নামবে বলে জানান শঙ্করবাবু।
সাধারণ ধর্মঘটের বিরোধিতা করছে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন (আইএনটিটিইউসি)। এ দিন ডালহৌসিতে প্রতিবাদসভায় আইএনটিটিইউসি-র নেতা তথা সরকারি মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, কাজে যোগদানে ইচ্ছুক শ্রমিক-কর্মীরা যাতে নির্বিঘ্নে কর্মস্থলে ঢুকতে পারেন তা দেখার জন্য তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে তাঁরা ‘কন্ট্রোল রুম’ খুলছেন। সেখানে সংগঠনের রাজ্য স্তরের নেতারা থাকবেন। শোভনদেববাবু বলেন, “কোনও শ্রমিক-কর্মী অসুবিধায় পড়লেই কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করবেন। আমাদের সংগঠনের নেতারা সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রমিক-কর্মীদের কর্মস্থলে ঢোকার ব্যবস্থা করবেন।” |
|
|
|
|
|