প্রথম জাতীয় লিগের ‘থিম সং’ গেয়েছিলেন বাপি লাহিড়ি। সেই ‘প্যায়ারসে গোল লে লো’ গানটা তখন বাজত যুবভারতী, কুপারেজ, মারগাঁওতে। মঙ্গলবার কল্যাণীতে সেই গানটা ‘সাউন্ড সিস্টেম’-এ বাজেনি। তবে মাঠে বরিসিচ, লালরিন্দিকারা বিপক্ষের তেকাঠিতে বল রাখলেই একদম ‘প্যায়ারসে’-ই গোল হজম করলেন এরিয়ানের গোলকিপার রাজু চক্রবর্তী। ছ’ গোল হয়ে যাওয়ার পর ৬৫ মিনিটের মাথায় এরিয়ান কোচ রাজুর পরিবর্তে জিয়াউল মোল্লাকে নামালেও গোলের দরজা বন্ধ হয়নি। শেষ লগ্নে পেনের শটে জিয়াও গোল হজম করায় চলতি মরসুমে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয় পকেটে নিয়ে মাঠ ছাড়লেন সৌমিক-নওবারা। তার চেয়েও বড় কথা, পাক্কা তিন বছর পর এরিয়ান কোচ রঘু নন্দীকে হারালেন ইস্টবেঙ্গল কোচ মর্গ্যান। তাও আবার সাত গোলের সুনামিতে ভাসিয়ে। তিন বছর ধরে এই ম্যাচটা হারার পরেই সমর্থকদের রোষ, বিদ্রূপ সব হজম করতে হয়েছে অভিজিৎ মণ্ডলদের সাহেব কোচকে। আজ কি মধুর প্রতিশোধ নিলেন? মর্গ্যান বলছেন, “ও সব মনে রাখি না। শেষ তিন ম্যাচে ১৫ গোল হল। মিস হয়েছে সত্তরটা। আজ গোল হজম করতে হওয়াটাই একমাত্র হতাশার।” |
প্রথম গোলের শট। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
চোট এবং জাতীয় শিবিরের কারণে আক্রমণে বিকল্প কম। সাদার্নের বিরুদ্ধে গোল করে দলকে জেতানোর পরে হলুদ কার্ড দেখে এই ম্যাচে চিডিও বাইরে। তাই এরিয়ানের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও চিন্তায় ছিলেন মর্গ্যান। কারণ একটাই। ‘চান্স ফ্যাক্টর’ বারবার রঘুর জিতে যাওয়া। চলতি লিগেও গ্রুপের খেলায় ২-১ জিতে এরিয়ান কোচ আনন্দবাজারে তাঁর সঙ্গে সফল কোচদের ফারাক বোঝাতে গিয়ে লিখেছিলেন, “এ বার হয়তো ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ মাখতে হবে।” সে কথা কি মর্গ্যানের কানে মঙ্গলবার কেউ চুপিচুপি তুলে দিয়েছিলেন? না হলে লাল-হলুদ কোচ ড্রেসিংরুমে বরিসিচদের কেন বলবেন, “আজ অন্তত সাত-আট গোল চাই”?
মাঠে হ্যাটট্রিক করে কোচের কথা রাখলেন অ্যান্ড্রু নিকোলাস বরিসিচ। রঘুর কাছে বারবার হারের শাপমুক্তি ঘটায় ম্যাচ শেষে তাই হাই-ভোল্টেজ হাসি ইস্টবেঙ্গল কোচের মুখে।
উলটো দিকে তখন এরিয়ানের কোচ দুষছেন আইএফএ-কে। বলছেন, “প্রথম দলের সাত জন নেই। বিদেশিরা এত লম্বা লিগে থাকছে না। তার উপর আর্থিক সমস্যা। আইএফএ এ ভাবে চালালে লিগের জৌলুশ আর থাকবে?”
অনুরোধ সত্ত্বেও মাঠে আসেননি দলের তিন বিদেশি। পারিবারিক কারণ দেখিয়ে গরহাজির প্রথম গোলরক্ষক শিবরামও। অসুস্থ দ্বিতীয় গোলরক্ষক। তবুও শেষ চেষ্টা হিসাবে ৪-৫-১ ছকে আক্রমণে বিশ্বরূপকে রেখে মাঝমাঠে পিন্টু মান্নাকে লাগিয়ে দিয়েছিলেন পেনকে নিষ্প্রভ করে দেওয়ার জন্য। যাতে লাল-হলুদের সাপ্লাই লাইনে ভাঁটা আসে। |
কীসের বদলা? আমি কখনওই ও সব মনে রাখি না। শেষ তিন ম্যাচে আমাদের ১৫ গোল হল। মিস হয়েছে আরও সত্তর। আজ গোল হজমটাই একমাত্র হতাশার।
ট্রেভর জেমস মর্গ্যান |
বাজে গোল হজম করলাম। প্রথম দলের সাত জন নেই। বিদেশিরা এত লম্বা লিগে থাকছে না। রয়েছে আথির্ক সমস্যা। আইএফএ এ ভাবে চালালে লিগের জৌলুশ আর থাকবে? বড় দলকে নিয়েই বরং লিগ চলুক।
রঘু নন্দী |
|
রিজার্ভ বেঞ্চে বসে রঘুর সেই চাল বুঝতে মর্গ্যানের সময় লাগল মিনিট দশেক। তার পরেই মাঝমাঠ থেকে এরিয়ান রক্ষণে ‘ওভারহেড’ বল ফেলতে বললেন লাল-হলুদ কোচ। ৪-১-৩-২ ছকে দুই স্ট্রাইকার বলজিৎ এবং বরিসিচ যাতে সেই বল ধরে গোলটা এনে দিয়ে রঘুর চাল বানচাল করে দিতে পারেন। সেই পরিকল্পনাতেই ১৩ মিনিটে গোলের খাতা খোলা বরিসিচের। তার ছ’মিনিট পরেই ডান পায়ের দূরপাল্লার শটে দ্বিতীয় গোল লালরিন্দিকার। এই দু’টো গোল হতেই হারিয়ে গেল রঘুর এরিয়ান। সেই সুযোগে বিরতির আগে দলের তৃতীয় গোল বরিসিচের।
দ্বিতীয়ার্ধে আরও গোলের জন্য ইস্টবেঙ্গল ঝাঁপাল গুলি খাওয়া বাঘের মতো। কোচও সুবোধ-সঞ্জু-লালরিন্দিকাকে তুলে নামিয়ে দিলেন আক্রমণাত্মক মিডিও অ্যালভিটো, ভাসুম, লোবোকে। এর পরেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এরিয়ান রক্ষণে আছড়ে পড়ল একের পর এক আক্রমণ। ঠিকানা লেখা পাস বাড়ালেন অ্যালভিটো-সৌমিক-নওবারা। সুনীলকে রক্ষণে রেখে গোলের জন্য উঠে এলেন উগাও। এতেই দিশাহারা এরিয়ান রক্ষণের শ্রীকান্ত-শুভঙ্কররা। সব সুযোগ কাজে লাগালে এ দিন ১৭ গোল হয়ে যায়। এই সুযোগেই ৬৩ মিনিটে পেনের থেকে বল পেয়ে লাল-হলুদ জার্সিতে প্রথম হ্যাটট্রিকটাও সেরে ফেললেন বরিসিচ। খেলা শেষে বলে গেলেন, “হ্যাটট্রিক করলেও প্রচুর গোল মিস হল। এগুলো হতে দেওয়া চলবে না।” গোল পেলেন বলজিৎও।
সুপার নাইনে পাঁচ ম্যাচে ১৫ পয়েন্ট পেয়ে আপাতত শীর্ষে ইস্টবেঙ্গল। চনমনে ফর্মে মিডফিল্ডাররা। ‘হাফ চান্সে’ও গোল এল। কেবল খচখচানি রাম মল্লিক। সুনীল-নওবাকে গতিতে ঘোল খাইয়ে রামের গোলটাই মঙ্গলবার সান্ত্বনা তিন বছর পর ‘যুদ্ধ-হারা’ রঘুর।
ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ, নওবা, ওপারা, সুনীল, সৌমিক, সুবোধ (অ্যালভিটো), সঞ্জু (ভাসুম), পেন, লালরিন্দিকা (কেভিন লোবো), বলজিৎ, বরিসিচ। |