|
|
|
|
সাক্ষাৎকার ... |
সামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনা
অনেক, অভাব যথার্থ সুচিন্তার
‘আমি বরাবরই মনে করেছি, যে খারাপ জিনিসগুলো ঘটে, তার অধিকাংশই চিন্তার অভাবে ঘটে,
লোকে খুব পাজি, এই কারণে ঘটে না। পাজি লোক যে নেই তা আমি বলছি না, কিন্তু তার চেয়েও
অনেক বেশি ক্ষতিকর হচ্ছে চিন্তাশূন্যতা।’ একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন |
সংসদের আসন্ন অধিবেশনে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা বিল পাশ হতে পারে। আপনি সম্প্রতি বলেছেন, এই বিল যে আনা হচ্ছে, সেটাই একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু স্বাধীনতার পঁয়ষট্টি বছর পরে এই আইন অনেক দেরি হল না কি?
দেরি হল, ঠিকই। কিন্তু সমস্যাটার তো অনেক ক’টা রূপ আছে। কিছু কিছু উদ্যোগ, যেমন রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম, তাতে লোকে কাজ পাচ্ছে, তাতে রোজগার হবে, তা দিয়ে খাবার কিনতে পারবে, সুতরাং এই প্রকল্পের সঙ্গেও তো খাদ্য নিরাপত্তার যোগ আছে। প্রশ্ন হল, দারিদ্র নিয়ে কী কী করা হচ্ছে। দারিদ্রের একটা বড় রূপ হল খাদ্যাভাব, ক্ষুধার্ত থাকা। তার থেকে যে সমস্ত দৈহিক ও মানসিক সমস্যা হতে পারে, সেগুলো নিয়ে ভাবা দরকার। এই পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য নিরাপত্তা বিলটিতে ক্ষুধার ওপর যেমন স্পষ্ট ভাবে জোর দেওয়া হয়েছে, এর আগের কিছু প্রকল্পের সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার যোগ থাকলেও সেখানে হয়তো ততটা স্পষ্ট ভাবে সেই জোরটা দেওয়া হয়নি। সে দিক থেকে এটা নিশ্চিত ভাবেই একটা বড় পদক্ষেপ। আর নানা দিক থেকে যখন বলা হচ্ছে সরকারের টাকার ঘাটতি আছে, এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এত টাকা বাড়তি খরচ করার সামর্থ্য সরকারের আছে কি না সেই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তখন এই আইনের উদ্যোগটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া জানিয়েছেন, বাজেট ঘাটতি আছে বলে খাদ্য নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় খরচ করা যাবে না এটা কখনওই বলা চলে না।
মন্টেক, বা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কিন্তু এ কথা বরাবরই বলে আসছেন। সরকার তো নানা খাতে খরচ করে থাকেন। এখন খাদ্য বাবদ ভর্তুকি দিতে সরকারের খরচ পড়ে বোধহয় সত্তর হাজার কোটি টাকার মতো। খাদ্য নিরাপত্তার নতুন পরিকল্পনা চালু হলে খরচটা সম্ভবত এক লক্ষ কোটি টাকার কিছু বেশি হবে। বাড়তি খরচটা তত প্রচণ্ড বেশি নয়। একটা অন্য হিসেব পাশাপাশি দেখতে পারি। এখন ডিজেলে ভর্তুকি দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ হয় বোধহয় একানব্বই হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, ডিজেলে ভর্তুকি তুলে দিতে পারলে তো একানব্বই হাজার কোটি টাকা উঠেই রয়েছে বলা যায়। ডিজেলে পুরো ভর্তুকিটা এক বারে তুলে দেওয়া সম্ভব বা সঙ্গত কি না, সেটা নিশ্চয়ই বিচারসাপেক্ষ। কিন্তু যেহেতু সরকারের অর্থাভাব আছে, সুতরাং মানতেই হবে, ডিজেলে ভর্তুকি এবং খাদ্য ভর্তুকির মধ্যে একটা রেষারেষি আছে। ডিজেলের ভর্তুকি থেকে যাঁরা উপকার পান তাঁদের অনেককেই নিশ্চয় ধনী বলা যাবে না, কিন্তু যাঁরা খেতে পাচ্ছেন না, সে-রকম পরিবারের তুলনায় তাঁদের অবস্থা যে ভাল, সেটা তো বলতেই হবে। সুতরাং আমাদের বুদ্ধি এবং হৃদয় দিয়ে বিবেচনা করতে হবে কোন খাতে কতটা ভর্তুকি দেওয়া দরকার। এখন খাদ্য ভর্তুকি দিতে যে খরচ হয় তার মধ্যে নিশ্চয়ই নানা ভুলত্রুটি আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলাই যায়, একটা আর্থিক নিয়োগের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই মন্টেক বলেছেন যে, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য টাকা নেই বললে খুব ভুল বলা হবে।
এই যে ‘টাকা নেই’ এটা তো বিজনেস মিডিয়া প্রবল ভাবে প্রচার করছে, সব ক’টা কাগজে বলছে যে, এত খরচ চালানো যাবে কী করে। তাদের মতে, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এত বেশি খরচের পরিকল্পনাটা বাজেটের দিক থেকে ভয়ানক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। এ প্রশ্ন ঠিক ভাবে বিচার করতে গেলে দেখতে হবে, কী কী খাতে সরকার বেশি টাকা খরচ করছে। আর তা হলেই দেখা যাবে, অন্তত পাঁচ-ছ’টা জিনিস আছে, বুদ্ধি-বিবেচনা অনুসারে যার একটা বা কয়েকটা খাতে বাজেট কাটলে খাদ্য নিরাপত্তার টাকাটা উঠে আসবে।
|
প্রচার ও বাস্তব
‘বিজনেস মিডিয়াই খুব শোরগোল তুলে প্রচার করেছে যে, একে দেশের গ্রোথ কমে গেছে,
তার ওপরে এই সব ‘আজেবাজে’ খরচ করলে দেশের খুব সমস্যা হবে। কিন্তু মানবকল্যাণের
জন্য এবং অর্থনৈতিক প্রসারের জন্যও এই সরকারি প্রচেষ্টার খুবই প্রয়োজন।’প্রতীচী ইনস্টিটিউট,
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কলকাতা ক্যাম্পাস। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
খাদ্য নিরাপত্তা বিলটিতে শিশুদের পুষ্টির ব্যবস্থায় নানা ঘাটতি আছে। এই বিষয়ে সম্প্রতি একটি আলোচনাসভায় আপনি আপনার গুরুত্বপূর্ণ অভিমত প্রকাশ করেছেন। শিশুদের পুষ্টির ক্ষেত্রে তো নানা দিক থেকেই ঘাটতি আছে। যেমন স্যানিটেশন-এর পর্যাপ্ত আয়োজন নেই বলেও তো...
নিশ্চয়ই, স্যানিটেশন এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেমন আরও অনেকগুলো জিনিসই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকগুলো বিষয়েই করণীয় অনেক। তবে আমি এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা আইনটির বিষয়েই বলেছিলাম। শিশুদের পুষ্টির জন্য কী কী করা উচিত, সে বিষয়ে আমাদের দেশে অনেক কিছুই বলা যায়। যেমন সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, প্রত্যেকটি শিশুর পর্যাপ্ত খাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। এবং আমাদের ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট স্কিম বা আই সি ডি এস-এ বলা হয়েছে, সদ্যোজাত শিশু থেকে শুরু করে বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য মিড ডে মিল প্রকল্প আছে। এ রকম নানা ধরনের কয়েকটা আয়োজন রয়েছে। কিন্তু এই যে আইনটা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, এতে খাদ্য নিরাপত্তার অনেক ক’টা দিককে উপেক্ষা করা হচ্ছে।
তার সঙ্গে আর একটা সমস্যা যোগ হয়েছে। একেবারে খুব ছোট যারা, তাদের বাদ দেওয়া যেতে পারে কি না, সেটা নিয়ে ভাবনা চলছে। বিল-এ তাদের বাদ দেওয়া হয়নি, কিন্তু যে স্ট্যান্ডিং কমিটি বিলটির পর্যালোচনা করেছেন, তাঁরা বলেছেন, খুব ছোট শিশুদের এই আইনের আওতা থেকে বাদ দিয়ে তার বদলে প্রসূতিদের পাঁচ কিলোগ্রাম করে বাড়তি খাদ্যশস্য দেওয়া হোক। প্রসূতি মেয়েদের বাড়তি খাবার দিলে তো ভালই, কিন্তু তার ফলে তো আর এক-বছর দু-বছরের বাচ্চার খাদ্যাভাব চলে যাচ্ছে না!
সুতরাং ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই রকম যে, সুপ্রিম কোর্ট যা বলেছেন, খাদ্য নিরাপত্তা বিল তার থেকে এক ধাপ কম, আবার স্ট্যান্ডিং কমিটি তার থেকে আরও এক ধাপ কম। এখন এই দুটোই যে বাচ্চাদের ওপর আঘাত দিচ্ছে, সারা জীবন ধরে তাদের স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার মানের ওপর এর প্রভাব পড়বে।
এই প্রসঙ্গে চিনের অভিজ্ঞতা প্রাসঙ্গিক। সে কথায় যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে জেমস হেক্ম্যানের কথা ওঠে। হেক্ম্যান শিকাগো ইউনিভার্সিটির নামজাদা অর্থনীতিবিদ, নোবেল প্রাইজও পেয়েছেন। খাওয়াদাওয়া, স্বাস্থ্য, ইত্যাদি সব ব্যাপারে বাচ্চাদের যদি প্রথম থেকে ঘাটতি থাকে, তা হলে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে কতটা ব্যাঘাত ঘটে, সেটা তিনি দেখিয়েছেন। এখন, চিনে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, চায়না ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশন সি ডি আর এফ। ওঁরা জেমস হেক্ম্যান এবং আমাকে ওঁদের সিনিয়র অ্যাডভাইজর হতে অনুরোধ করেছিলেন এবং আমরা তাতে সম্মত হয়েছিলাম। বাচ্চাদের পুষ্টি চিনে ভারতের থেকে অনেক ভাল অবস্থায় আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওদের কিছু কিছু ঘাটতি আছে, সেগুলো কী ভাবে পূরণ করা যায়, ওঁরা সেটাই জানতে চাইছিলেন। এখানে বলি, সাংহাইয়ের মতো কিছু কিছু জায়গায় স্কুলে খাবার দেওয়া হয় বটে, কিন্তু চিনে সামগ্রিক ভাবে আমাদের দেশের মিড ডে মিল প্রকল্পের মতো কোনও ব্যবস্থা নেই। স্কুলের বয়স হওয়ার আগে বাচ্চাদের খাবার দেওয়ারও কোনও সিস্টেম্যাটিক ব্যবস্থা নেই। ওঁরা বললেন, এ বিষয়ে ভারতের, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে যেখানে বাচ্চাদের পুষ্টির প্রকল্পগুলি ভাল কাজ করেছে, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সে নিয়ে অনেক আলোচনা হল।
যেটা লক্ষ করা দরকার সেটা হচ্ছে এই যে, চিনে বাচ্চাদের অপুষ্টি যে আমাদের দেশের চেয়ে কম, সেটা কোনও বিশেষ প্রকল্পের কারণে নয়। চিনে যে হারে মজুরি ও বেতন বেড়েছে, বিশেষ করে গত কুড়ি বছরে, সেটা ভারতের থেকে ছ’গুণ বেশি। একমাত্র সিভিল সার্ভেন্টদের বেতন ছাড়া আর কোনও ক্ষেত্রেই এ ব্যাপারে চিনের সঙ্গে ভারতের তুলনা চলে না। আমাদের দেশে অর্থনীতির প্রগতি যে হারে হয়েছে, সাধারণ লোকের রোজগারের বৃদ্ধির হার তার কাছাকাছি নয়। অর্থাৎ, চিনে যে অপুষ্টি কম, তার কারণটা খুব ‘ক্ল্যাসিকাল’ অর্থনৈতিক প্রগতির সঙ্গে লোকের রোজগার বেড়েছে, ফলে তাঁরা বেশি খাবার কিনতে পেরেছেন, ফলে তাঁদের পুষ্টি বেড়েছে, ভারতে সেটা অনেক কম হয়েছে।
আরও নানা সমস্যা আছে। যেমন, টয়লেটের অভাব। ভারতে প্রায় অর্ধেক লোকের জন্য শৌচাগার নেই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সামর্থ্য নেই। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ করতে হবে পরিকল্পনার ত্রুটি যাঁরা বাইরে নানা জায়গায় কাজ করছেন, তাঁদের জন্য যথেষ্ট শৌচাগার তৈরি করা হয়নি। তা ছাড়া, বড় বড় শহরে, যেমন দিল্লি বা গুড়গাঁওয়ে, বহু বাড়ি তৈরি হচ্ছে যেখানে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার্স আছে, কিন্তু গৃহকর্মীদের শৌচাগারের অত্যন্ত অভাব। আমার মতে, শহরের পরিকল্পনায় এটা একেবারেই অনুমোদন করা উচিত নয়। কত লোকের থাকার জায়গা হচ্ছে, ক’টা ঘর তৈরি হচ্ছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টয়লেট তৈরি করতে হবে, এ একেবারে আইন করে বেঁধে দেওয়া উচিত। ভারতে একমাত্র চণ্ডীগড়ে এই অভাবটি নেই, কারণ সেখানে কর্বুসিয়ের শহর তৈরির সময় এই প্রয়োজনের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ইউরোপেও এ ব্যাপারে অতীতে সমস্যা ছিল, ওরা সেটা দূর করে ফেলেছে রোজগার বেড়েছে বলেও, আবার সরকার নানা রকম নিয়ম জারি করেছে বলেও। চিনে গোড়া থেকেই এ দিকে নজর দেওয়া হয়েছে, ফলে সমস্যাটা অনেক কম। ভারতে একেবারেই নজর দেওয়া হয়নি।
সুতরাং, বাচ্চাদের অপুষ্টি, টয়লেটের অভাব, বা অন্য নানা অপ্রাপ্তির বিষয় বিবেচনা করার কারণ আছে বলে আমি মনে করি। তবে তা করতে গিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বিশেষ করে নজর দিতে হবে। এক দিকে, দেশের অর্থনীতির প্রগতি কতটা হচ্ছে; অন্য দিকে, সরকারি সাহায্য বা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কতটা কাজ করছে।
আর একটা ব্যাপার লক্ষ করা দরকার। চিনে মজুরি ও বেতন হু হু করে বেড়েছে, তার পাশাপাশি কিন্তু জাতীয় উৎপাদন ও আয়ের বৃদ্ধিও হয়েছে খুব দ্রুত। মজুরি বেশি বলে অর্থনীতির প্রগতিতে ব্যাঘাত ঘটছে, এমনটা একেবারেই বলা যাবে না।
রোজগার বাড়লে তো পুষ্টি ইত্যাদির কারণে মানুষের কর্মক্ষমতাও বাড়ে, অর্থনীতি বেশি উৎপাদনশীল হয়...
সেটাও আমার একটা বক্তব্য। এশিয়ান মডেল যেটাকে বলে জাপান থেকে শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, তাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং, তার পর চিন তার ধরনটাই হল: এক দিকে মজুরি বাড়ানো, অন্য দিকে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করা, যার ফলে উৎপাদনশীলতা এমন হারে বাড়তে থাকবে যাতে অর্থনীতির প্রসার দ্রুত এবং স্থায়ী হয়। জাপানে ১৮৬০-এর দশকে মেজি রেস্টোরেশন-এর সময় থেকে এ বিষয়ে চিন্তা করা হয়েছিল। সেই সময় ওঁদের গ্রামাঞ্চলে সরকার যত খরচ করত, তার শতকরা ৪৫ থেকে ৪৭ ভাগ বরাদ্দ হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষার জন্য। ওঁরা ঠিক করেছিলেন, এক ধাক্কায় সকলের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ১৮৬৮’তে শুরু করলেন, ১৯০৫-এর মধ্যে নিরক্ষরতা দূর হল। তখন ওখানে সেনসাস ছিল না, কিন্তু সেনাবাহিনীতে লোক নেওয়ার সময় দেখা হত, প্রার্থীরা সাক্ষর কি না। আগে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আসা প্রায় অর্ধেক লোক নিরক্ষর ছিলেন, ১৯০৫-এ দেখা গেল প্রায় সবাই সাক্ষর। ১৯১৩’র মধ্যে হিসেব পাওয়া গেল জাপানে অন্য যে কোনও দেশের চেয়ে বেশি বই ছাপা হচ্ছে, আমেরিকার দ্বিগুণেরও বেশি। এমন পরিবর্তনটা হল শিক্ষায় এতটা জোর দেওয়ার ফলেই। পাশাপাশি স্বাস্থ্যতেও খুবই নজর দেওয়া হয়েছিল। এগুলোয় আমরা একেবারেই জোর দিইনি। আমাদের প্রধান সমস্যা সেখানেই। শিক্ষা-প্রচেষ্টার অভাব, স্বাস্থ্য-প্রচেষ্টারও।
খাদ্য নিরাপত্তা বিল সম্পর্কে বার বার বলা হচ্ছে যে, অত টাকা কী করে জোগাড় হবে?
সরকার কিন্তু বলছেন না সেটা। মনমোহন সিংহের সরকার সম্বন্ধে অনেক সমালোচনার কারণ থাকতে পারে, কিন্তু এটা বলতেই হবে যে তাঁরা কখনও বলেননি, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য টাকা নেই। এবং বিজেপি থেকেও কিন্তু এই উদ্যোগের তেমন কোনও বিরোধিতা করা হয়নি। প্রতিবাদটা প্রধানত এসেছে বিজনেস মিডিয়া থেকে। তারাই খুব শোরগোল তুলে প্রচার করেছে যে, একে দেশের গ্রোথ কমে গেছে, তার ওপরে এই সব ‘আজেবাজে’ খরচ করলে দেশের খুব সমস্যা হবে। কিন্তু মানবকল্যাণের জন্য এবং অর্থনৈতিক প্রসারের জন্যও এই সরকারি প্রচেষ্টার খুবই প্রয়োজন।
এই প্রচারের মোকাবিলা করাটা তো জরুরি ছিল। এ ব্যাপারে আমাদের বামপন্থী দলগুলির একটা বিশেষ দায়িত্ব ছিল না কি?
এ বিষয়ে তাঁদের সহানুভূতি আছে, কিন্তু যা করা দরকার, যতটা করা দরকার, কার্যত তাঁরা তা করছেন না। খাদ্য ভর্তুকি বিষয়ে তাঁদের সহানুভূতি তাঁরা জোরগলায় জানাচ্ছেন, কিন্তু এটাও খুবই জোর দিয়ে বলছেন যে, এল পি জি আর ডিজেলের ভর্তুকি বন্ধ করা যাবে না। হয়তো তাঁরা এটা ভোটের কথা মাথায় রেখেই করছেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এ কথাও বলতে হবে যে, এর মধ্যে একটা গুনতিরও ভুল বোধহয় আছে। এটা ঠিকই যে, বাচ্চাদের পুষ্টি নিয়ে যতটা আওয়াজ তোলা যায়, এল পি জি বা ডিজেল ভর্তুকি নিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি আওয়াজ তোলা যাবে। কিন্তু এটা ভেবে নেওয়া ঠিক নয় যে সাধারণ লোকেরা এতই মূর্খ যে, ওই আওয়াজের ফলেই তারা মনে করবে, তাদের খাদ্যাভাবের চেয়ে এল পি জি, ডিজেল, বিদ্যুৎ বা সারের ভর্তুকির ব্যাপারটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই কথা ভেবেই তারা ভোট দেবে যদিও অধিকাংশ লোকের এমন কোনও সরঞ্জাম নেই যাতে এল পি জি ব্যবহার করা যায় এবং তিন ভাগের এক ভাগ লোকের বাড়িতে বিদ্যুতের কানেকশন নেই! আমার ধারণা, এখানে বামপন্থীদের একটা স্ট্র্যাটেজিক ভুলও হচ্ছে সাধারণ লোকের স্বার্থের দিকে যথেষ্ট নজর না দিয়ে শুধু এই সব নিয়ে শোরগোল করাটা একটা নৈতিক ভুল তো বটেই, কিন্তু এই করে ভোট পাওয়ারও সুবিধে হবে বলে আমি মনে করি না।
কেন্দ্রীয় সরকার সম্ভবত চাইছেন ডিজেল ভর্তুকিটা তুলে দিয়ে যে টাকাটা বাঁচবে সেটা খাদ্য নিরাপত্তার কাজে লাগাতে। এর পিছনে দেশপ্রেমের কারণ আছে, কিন্তু তার সঙ্গে ভোটিং স্ট্র্যাটেজিরও সম্পর্ক আছে। এটা তো মাথা গুনলেই বোঝা যায়!
বামপন্থী দলগুলি হয়তো মনে করেন, যাঁরা বাগ্বাজ, তাঁদের কথাগুলোই সবার কানে এত ঘোরে যে তাঁরা নিজেদের খাদ্যাভাব নিয়ে চিন্তা করবেন না, অন্যদের গ্যাসের দাম বাড়ল, তার প্রতিবাদে ওঁদের ভোট দেবেন!
এটা কি শুধুই ক্ষমতার জন্যে, না কি এর পিছনে একটা ‘মরাল ব্যাঙ্করাপ্সি’ আছে?
আমার ধারণা, এটার প্রধান কারণ সুচিন্তার অভাব। আমি বরাবরই মনে করেছি, যে খারাপ জিনিসগুলো ঘটে, তার অধিকাংশই চিন্তার অভাবে ঘটে, লোকে খুব পাজি, এই কারণে ঘটে না। পাজি লোক যে নেই তা আমি বলছি না, কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর হচ্ছে চিন্তাশূন্যতা।
আপনি আপনার দি আইডিয়া অব জাস্টিস বইতে ‘ভাল হওয়া’ এবং ‘স্মার্ট হওয়া’র মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলেছেন...
হ্যাঁ, সেটা উইট্গেনস্টাইনের কথার সূত্র ধরে বলেছি। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, আমাদের ভাবার ক্ষমতা যখন আমরা ব্যবহার করি না, তখন এমন অনেক জিনিস করতে পারি, সমাজের পক্ষে যা ক্ষতিকারক, এবং এ নিয়ে ভাবলে আমরা নিজেরাও সেটা বুঝতে পারব। ‘স্মার্ট’ চিন্তা ভাল হওয়ার একটা বড় উপায়। তাঁর এই কথাটার সঙ্গে আমি একেবারেই একমত।
খাদ্য নিরাপত্তা বা শিক্ষার অধিকারের মতো আরও অনেক জিনিস তো আমাদের দরকার। সে জন্য সামাজিক আন্দোলন জরুরি। আপনি তার সম্ভাবনা কেমন বলে মনে করেন?
আমি মনে করি, সম্ভাবনা খুবই আছে, কিন্তু তার জন্য সুচিন্তিত নেতৃত্বের বিশেষ প্রয়োজন। বামপন্থীদের স্বাভাবিক সহানুভূতির সঙ্গে এর খুবই যোগ আছে, তবে তার প্রকাশ আরও স্পষ্ট ভাবে হওয়া দরকার। অতীতে কিন্তু বামপন্থীরা নানা ভাবেই চিন্তার নতুনত্ব দেখিয়েছেন। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। পঞ্চাশের দশকের কথা, আমি তখন ছাত্র। বহুরূপী থেকে খুব সুন্দর ভাবে ‘রক্তকরবী’ করা হল। একটা প্রশ্ন উঠল, তাঁরা কেন এই নাটকটি করলেন? কারণ রক্তকরবীতে তো এক দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবের বিরুদ্ধে বলেছেন! এর উত্তরটা খুঁজে পাওয়া কিন্তু কঠিন নয়। মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতার আগেই অনেকে টেররিস্ট মুভমেন্ট থেকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের চিন্তাটা ছিল এই রকম যে আমরা যে টেররিস্ট মুভমেন্ট করতাম, যদিও তাতে গায়ের ঝাল মেটে, কিন্তু তাতে করে দেশের কোনও পরিবর্তন হবে না, ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে যাবে না, তাদের যেতে বাধ্য করার একমাত্র উপায় মাস মুভমেন্ট। বলা যেতে পারে, রক্তকরবীর সঙ্গে এঁদের চিন্তাধারার অর্ধেকটা সামঞ্জস্য ছিল। টেররিজম করে শেষ অবধি কিছু হবে না এই কথাটা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এবং কমিউনিস্টরাও এটা মনে করছিলেন। কিন্তু মাস মুভমেন্টের বিষয়ে রক্তকরবীতে খুব বেশি কিছু নেই। বহুরূপী যখন রক্তকরবী স্টেজ করলেন, তখন তাঁরা একটা লাইন যোগ করলেন। যখন নাটকটা শেষ হচ্ছে, তখন বলা হল চল্ লড়াইয়ে যাই।’ এই যে লাইনটি তাঁরা যোগ করেছিলেন, তার মধ্যে মাস মুভমেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ নিয়ে ভাববার ইঙ্গিত ছিল, এবং রবীন্দ্রনাথের সমর্থন তার পিছনে আছে, এটাও মনে করার ন্যায্য কারণ ওঁরা দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন।
এটা খুবই লক্ষ করার মতো ব্যাপার যে, বামপন্থী শিল্পীরা তখন নানা ভাবে আশ্চর্য রকম চিন্তার খোরাক জুগিয়েছেন। যেমন খাজা আহমদ আব্বাস তাঁর ‘ধরতী কে লাল’ চলচ্চিত্রে খুব সাবলীল ভাবে তাঁর নতুন ধরনের চিন্তা আমাদের সামনে রেখেছিলেন। এই সব চিন্তার সঙ্গে বামপন্থীদের কাজ ও লক্ষ্যের যোগ ছিল। যেমন, ল্যান্ড রিফর্মস-এর জন্য যে আন্দোলন হয়েছে, সেটাকে কার্যত মাস মুভমেন্টই বলতে হবে।
কিন্তু অতীতে যে সব বিষয় নিয়ে মাস মুভমেন্ট হয়েছে, সে সোশালিস্টই বলা হোক বা কমিউনিস্টই বলা হোক, এখন তো বামপন্থীদের সেগুলোয় উৎসাহ কম বলেই মনে হয়। এখন তো ওই পঞ্চায়েত দখল করব, আমাদের লোককে রাখব, ওদের লোককে মেরে ঠান্ডা করে দেব, এই সব। সব পার্টিতেই এ দিকে যাওয়ার লোভ যথেষ্ট প্রকট। কিন্তু সেটা দমন করাও খুবই জরুরি।
|
সাক্ষাৎকার: অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় |
|
|
|
|
|