ভারতের দুই প্রান্তে দুই প্রতিবেশী দেশ এখন সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের দুই রাজনৈতিক সন্ধিলগ্ন দেখিতেছে। বাংলাদেশে ঢাকা হইতে শুরু করিয়া অন্যান্য জেলার সদর-শহর কিংবা উপজেলার মফস্সলি শহরের রাস্তায় রাস্তায় ইসলামি মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠন জামাত-এ-ইসলামির বিরুদ্ধে যখন স্বতঃস্ফূর্ত জনজোয়ার নামিয়াছে, রাজনীতি-নিরপেক্ষ ভাবেই সাধারণ মানুষের জাতীয় আবেগ তুঙ্গ স্পর্শ করিয়াছে, ঠিক সেই সময়ে মৌলবাদী ইসলামের তীব্র হিংসাবহ্নি ছারখার করিতেছে ভারতের পশ্চিমী প্রতিবেশী পাকিস্তানের জনজীবনকে। কখনও আঘাত আসিতেছে দেশের কেন্দ্র ইসলামাবাদে কিংবা লাহৌরে, কখনও বা বোমাবর্ষণ হইতেছে প্রত্যন্তের শহরে গ্রামে বাজারে মসজিদে। গত সপ্তাহান্তে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কেটা শহরে এমনই এক করাল বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ গেল একাশি জন মানুষের। তাঁহারা সকলেই মুসলিম, এবং প্রায় সকলেই ‘হাজারা’ শিয়া গোষ্ঠীভুক্ত মুসলিম। কোনও রাজনৈতিক কারণে কিন্তু তাঁহারা সঙ্ঘবদ্ধ হন নাই, নিতান্ত সাধারণ দৈনন্দিন জীবনযাপনের ফাঁকে তাঁহাদের উপর নামিয়া আসিয়াছে সাক্ষাৎ মৃত্যু। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ যখন ধর্মীয় অন্ধতার বেড়াজাল কাটিয়া জাতীয় আন্দোলনের সন্ধানে ব্যাপৃত, পাকিস্তান তখন ধর্মীয় অন্ধতার পিচ্ছিল কালিপথ বাহিয়া সংকীর্ণ হইতে সংকীর্ণতর বিশ্ববীক্ষায় নিমজ্জমান, অ-মুসলিমদের সহিত অ-সুন্নি মুসলিমরাও এখন জাঁকিয়া-বসা জঙ্গি সংগঠনগুলির প্রাত্যহিক নিধন-লক্ষ্য। দুই দেশেই গণতন্ত্র তাহার শৈশবে, কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের পথ বাহিয়া একটি দেশের সরকার ‘বড়’ হইতেছে, অন্য দেশের সরকার অর্থহীনতা ও পরিহাসের নামান্তর হইয়া উঠিতেছে।
যে জঙ্গি গোষ্ঠীটি এই ন্যক্কারজনক ঘটনার দায় সগৌরব স্বীকার করিয়াছে, সেই লস্কর-এ-জংভির নামটি একদা গৃহীত হইয়াছিল পাকিস্তানের এককালীন সুন্নি গোষ্ঠীভুক্ত কট্টরভাবাপন্ন নেতা, ‘সিপাহ-এ সাহাবা পাকিস্তান’ নামক মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ নওয়াজ জংভি-র নাম হইতে। ১৯৭০-এর দশকে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মধ্যে শিয়া উত্থানের সম্ভাবনা অনুমান করিয়া পাকিস্তানে সিপাহ-এ-সাহাবা গোষ্ঠীর হিংসাত্মক কার্যকলাপ ছড়াইয়া পড়ে, এবং আশির দশকে পাক-রাজনীতির নেপথ্য-মঞ্চে একটি বিশিষ্ট স্থান অর্জন করে, ক্রমে দেশের অভ্যন্তরে শিয়াবিরোধী সন্ত্রাসবাদের অন্যান্য সমদর্শী প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়। এই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিই ক্রমে তালিবান-প্রভাবে সামাজিক ভাবে অনেক বেশি রক্ষণশীল, ও আক্রমণাত্মক হইয়া উঠিয়া জনজীবন নিষ্পেষণ করিতেছে।
পাকিস্তানি রাষ্ট্রের একটি দৃঢ় সংগঠিত সামরিক প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও, পরমাণু-অস্ত্র সম্ভারে সম্মানিত আন্তর্জাতিক প্রতিপত্তি থাকিতেও যে এই মৌলবাদী শক্তি-সমবায়ের সামনে তাহা কতটাই অকার্যকরী, তাহা গত কয়েক বৎসরেই প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে। দেশ জুড়িয়া দিগ্বিদিকে বোমাবিস্ফোরণ আত্মঘাতী হানার চরকিবাজিতে সহস্র মানুষের প্রাণ বিসর্জন সত্ত্বেও কোনও কার্যকরীপদক্ষেপ লওয়া যায় নাই, তালিবান প্রভাব কিংবা কট্টর সুন্নি জঙ্গিবাদ, কোনওটিকেই প্রতিহত করা যায় নাই, প্রধান নেতাদের কাহাকেও গ্রেফতার করা হয় নাই। অথচ একটির পর একটি দুর্ঘটনা ঘটিয়া চলিতেছে, বাজারহাট, স্কুলকলেজ, ব্যবসাবাণিজ্য সবই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হইতেছে, প্রাত্যহিক প্রাণভয়ের সঙ্গে যুক্ত হইতেছে অসীম ব্যবহারিক দুর্দশা ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি। জনতা ক্ষোভে ফুঁসিতেছে, কিন্তু সেই ক্ষোভকে ঠিক পথে চালিত করিবার মতো সক্ষম রাজনৈতিক নেতৃত্ব নাই। ইতিমধ্যেই হাজির পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের সময়। এ দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার কোনও ক্রমে তাহার পূর্ণ মেয়াদ পাঁচ বৎসর কাটাইয়া পরবর্তী নির্বাচনের নির্ঘণ্টে পৌঁছাইল ঠিকই, তবে এক রক্তাক্ত ইতিহাসও গত পাঁচ বৎসরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি যুক্ত হইয়া রহিল। ২০০৭ সালের শেষে বেনজির ভুট্টোর নিধনের মধ্য দিয়া শুরু হইয়াছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনী পালা। সন্দেহ হয়, এই বারের ভোটযাত্রার ভবিতব্যও একই রকম অশান্ত ও রক্তাক্ত। |