দু’দিন আগেও ছিলেন রক্ষাকর্তা। কিন্তু চাপের মুখে মঙ্গলবার মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন ফিরহাদ (ববি) হাকিম।
গার্ডেনরিচ-কাণ্ড থেকে দূরত্ব তৈরির চেষ্টায় এ দিন বীরভূমের মুরারইয়ে ববি বলেন, “আমি কী করেছি? আমি কি গুলি চালিয়েছি?” কলকাতা পুরসভার ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের দলীয় কাউন্সিলর ইকবালের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ববির মন্তব্য, “আমার দলের কাউন্সিলর কোথায় কী করছেন, তার আমি কী জানি!”
অথচ আট দিন আগে গার্ডেনরিচে গুলি চালানোর ঘটনার ঠিক পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে মুন্নার পাশে দাঁড়িয়ে ববি বলেছিলেন, “ইকবালকে খুন করার চক্রান্ত করেছিল মোক্তার ও তার বাহিনী। ইকবালকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে মৃত্যু হয়েছে সাব ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরীর।” পরের দিন পুলিশ যখন ইকবালকে অভিযুক্ত করে এফআইআর দায়ের করল, তখনও দেখা গেল ববি ১৫ নম্বর বরো চেয়ারম্যানের পাশেই রয়েছেন। মহাকরণে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “ইকবাল এ কাজ করেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।”
এর পরেই ইকবাল এবং ববির সম্পর্ক নিয়ে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল হয়ে ওঠে। ববি ইকবালকে সমর্থন করে থাকলে তা উচিত কাজ হয়নি বলে মন্তব্য করেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। জানা যায়, এর আগেও ইকবালের পক্ষ নিয়ে পুলিশকে ধমকেছিলেন ফিরহাদ। মুন্নার মদতে চলা বেআইনি নির্মাণের ছবি তুলতে যাওয়া পুলিশ অফিসারদের ডিসি-র (বন্দর) সামনেই হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, মুন্নার বিরুদ্ধাচরণ করলে তাঁরই বাড়িতে সান্ত্রীর কাজ (সেন্ট্রি ডিউটি) করানো হবে। তখন ওই পুলিশ অফিসারদেরই মুন্নাকে স্যালুট ঠুকতে হবে।
এই সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেও দমেননি ববি। গার্ডেনরিচ কাণ্ডের আগের দিন রাতে বোমা বাঁধতে গিয়ে আহত ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রঞ্জিত শীলের ছেলের মৃত্যুর পরে রবিবার কেওড়াতলা শ্মশানে গিয়েছিলেন। সেখানে ইকবালের মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
দু’দিনের মধ্যে ববির এই ভোলবদলে বিস্মিত মুন্নার ঘনিষ্ঠ মহল। তাঁদের ধারণা, পরিস্থিতি যে দিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে মুন্নাকে যে গ্রেফতার করা হবে সেটা বুঝতে পারছেন পুরমন্ত্রী। আর তাই নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বাঁচাতে মুন্নাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন তিনি। ক্ষুব্ধ মুন্না অনুগতদের বক্তব্য, মুন্নার কাঁধে ভর করেই বন্দর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন ববি। তাঁর উপরে নির্ভর করেই এখানে রাজনীতি করতেন। আর এখন পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কেটে পড়তে চাইছেন। মুন্না শিবিরের এই ক্ষোভ বন্দর এলাকায় ববির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের উপরে কী প্রভাব ফেলে তা দেখতে আগ্রহী রাজনীতির কারবারিরা। |
তবে ববির মতো প্রভাবশালী মন্ত্রী অন্তত প্রকাশ্যে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় আপাতত মুন্নার উপরে চাপ বাড়বে এবং পুলিশের কাজের সুবিধা হবে বলেই মনে করছেন অনেকে। যদিও মঙ্গলবার পর্যন্ত তাঁর টিকির হদিশ পায়নি সিআইডি। সিআইডি-র এক তদন্তকারী অফিসারের মন্তব্য, “আমাদের সঙ্গে পুরোদস্তুর চোর-পুলিশ খেলা শুরু করেছেন মুন্না।”
পুলিশের চোখে ধুলো দিতে মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন মুন্না। রবিবার রাত ৯টায় পটনা থেকে তাঁর ঘনিষ্ঠ এক জনের মোবাইলে ফোন করেন মুন্না। যে নম্বর থেকে ফোন করা হয়েছিল তার খোঁজ করতে পটনা গিয়ে সিআইডি জানতে পারে সেটি পটনা স্টেশনের একটি পিসিও। এর পরে মুন্নার আর কোনও সূত্র পায়নি সিআইডি।
বস্তুত, মুন্না এখন কোথায় তা নিয়ে সিআইডি অফিসারেরা দ্বিধাবিভক্ত। কেউ মনে করছেন পটনা স্টেশন থেকে ফোন করার পরে ট্রেনে চেপে তিনি অন্যত্র চলে গিয়েছেন। সিআইডি-র অন্য অংশ মনে বলছে, বিহারেই কোথাও আছেন মুন্না। রবিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা বিভিন্ন সময়ে বিহারের মির্জাপুরের বিভিন্ন পিসিও থেকে কলকাতার ওই নম্বরে ছ’বার কথা বলেন বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন। পিসিওগুলির কোনওটি মির্জাপুর, কোনওটি শ্রীকৃষ্ণপুরী, কোনওটি পটনর। সব ক’টিই ১০-১২ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে। প্রতিটি পিসিও-র লোকজনকে মুন্নার ছবি দেখান সিআইডি গোয়েন্দারা। কিন্তু পিসিও-র লোকেরা বলেন, বহু মানুষ ফোন করতে আসেন, তার মধ্যে বিশেষ কাউকে মনে রাখা সম্ভব নয়।
গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের আর এক অভিযুক্ত, মুন্নার প্রবল প্রতিপক্ষ মোক্তারও ভিন্ রাজ্যে গা-ঢাকা দিয়েছে বলে সিআইডি-র দাবি। তাঁকে ধরার জন্যও একটি দল তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তাদের অভিযানেরও নিট ফল এখনও অবধি শূন্য।
মুন্না-মোক্তারকে ধরার ব্যাপারে সাফল্য কেন আসছে না তার ব্যাখ্যা দিয়ে সিআইডি-র এক কর্তা বলেন, “গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের তদন্তভার কলকাতা পুলিশের হাত থেকে আমাদের হাতে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারি নির্দেশ জারি হল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। কিন্তু দায়িত্ব হস্তান্তরের একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকে। ওই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করা, সিআইডি ও কলকাতা পুলিশের কর্তাদের মধ্যে সমন্বয় বৈঠকে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলি ঠিক করা এ সব সেরে পুরোদস্তুর মাঠে নামতে শুক্রবার বিকেল গড়িয়ে যায়। ওই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যেই মুন্না এই রাজ্য থেকে পালিয়ে যান বলে মনে করা হচ্ছে।”
কলকাতা পুলিশের এক অফিসার বলেন, “মুন্না যাতে আত্মসমর্পণ করেন, বুধবার বিকেল পর্যন্ত চেষ্টা চলছিল। মুন্না নিজেও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তার পরে তিনি গা ঢাকা দেন। আমরা সেই জায়গাটি চিহ্নিতও করে ফেলি। পর দিন, বৃহস্পতিবার যখন অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই জানতে পারি তদন্তভার দেওয়া হয়েছে সিআইডি-কে। ফলে আমাদের হাত গুটিয়ে ফেলতে হয়। তার মাসুল এখন দিতে হচ্ছে।”
শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এ দিন মালদহে দাবি করেন, “গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে সমস্ত অপরাধী ধরা পড়বে। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী ও সরকার স্বচ্ছ ভাবে কাজ করছে।”
গার্ডেনরিচের ঘটনায় ধৃত এক অভিযুক্তকে এ দিন অন্তর্বর্তী জামিন দিল আলিপুর আদালত। আবিদ হোসেন নামে ওই অভিযুক্তের আইনজীবী জানান, তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। বাকি ৯ জনের জামিনের আবেদন অবশ্য খারিজ হয়ে যায়। মহম্মদ ইসাহার এবং মহম্মদ বসির নামে দুই নাবালককে আড়িয়াদহের ধ্রুবাশ্রমে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দু’জনকেই বুধবার জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে হাজির করতে হবে। বাকি ৭ জনকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হেফাজতে রাখতে পারবে সিআইডি। |