মুখের খাবার ফুরিয়েছে কি ফুরোয়নি, ধেয়ে এল গুলি। পর পর পাঁচটা। সঙ্গে সঙ্গে আলগা হল হাতের মুঠো। আধ খাওয়া বিস্কুট তখন সেই মুঠোর লাগাম ছাড়িয়ে নিরুদ্দেশ। আর বিস্কুটের মালিক বছর বারোর বালাচন্দ্রনের নিথর দেহ মাটিতে। বুকে পাঁচটা গুলির দাগ। সময়টা ২০০৯-র মে মাস।
কিন্তু কী তার অপরাধ? আসলে প্রাক্তন এলটিটিই প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরনের ছোট ছেলে সে। তাতেই এই পরিণতি। এবং পুরো বিষয়টির সৌজন্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী। অন্তত তেমনটাই দাবি করা হয়েছে “নো ওয়ার জোন: দা কিলিং ফিল্ডস অফ শ্রীলঙ্কা” তথ্যচিত্রটিতে। সম্প্রতি তার কিছু খণ্ডচিত্র দেখানো হয় একটি ব্রিটিশ চ্যানেলে। আর তাতেই ধরা পড়েছে বালাচন্দ্রনের শেষ মুহূর্তের কাহিনি।
ঠিক কী হয়েছিল সে দিন?
তিনটি স্থিরচিত্রে ধরা পড়েছে গোটা ঘটনাটি। প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে বালাচন্দ্রন। দ্বিতীয় ছবিতে বিস্কুট জাতীয় খাবার খেতে দেখা যাচ্ছে তাকে। আর শেষ ছবিতে তার নিথর দেহ। বুক চিড়ে বেড়িয়ে গিয়েছে পাঁচ পাঁচটি গুলি। তথ্যচিত্রটির পরিচালক ক্যালাম ম্যাক্রের দাবি, তিনটি ছবি একই ক্যামেরায় তোলা। এবং সম্ভবত, শেষ ছবিটি থেকে দ্বিতীয় ছবিটির সময়ের ব্যবধান দু ঘণ্টার।
এতেই শেষ নয়।
গত বছরই বালাচন্দ্রনের নিথর গুলিবিদ্ধ দেহের ছবি প্রকাশ করেছিলেন ম্যাক্রে। সেই ছবি পরীক্ষা করেন বিশেষজ্ঞরা। তা থেকেই ধারণা করা হচ্ছে, প্রথম গুলিটা মাত্র দু থেকে তিন ফুট দূরত্ব থেকে ছোঁড়া হয়। অর্থাৎ যে বন্দুকটি দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়, তা তার হাতের নাগালের মধ্যেই ছিল। ম্যাক্রের নয়া তথ্যচিত্র আরও কিছু দাবি করছে। দেখা যাচ্ছে বালাচন্দ্রনের দেহের পাশে পড়ে রয়েছে আরও পাঁচটি দেহ। ম্যাক্রের মতে, এরা বালাচন্দ্রনের দেহরক্ষী তামিল টাইগার। তাদের নগ্ন করে, দু’চোখ বেঁধে মাথায় গুলি করা হয়।
এ সবের ভিত্তিতেই উঠছে নতুন দাবি। বালাচন্দ্রনের মৃত্যু আকস্মিক নয়। বরং শ্রীলঙ্কার সেনা ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে খুন করেছিল বারো বছরের সেই অপাপবিদ্ধ কিশোরকে। একই সঙ্গে উঠছে সেই পুরনো প্রশ্নও। শ্রীলঙ্কা-সেনা যে ‘তামিল টাইগার’ নিধনের শেষ পর্বে হাজার হাজার নির্দোষ তামিলকেও নৃশংস ভাবে শেষ করেছিল, সেই অভিযোগ আবার সামনে আনছে এই তথ্যচিত্র। আগামী মার্চে জেনিভায় তথ্যচিত্রটিতে দেখানো হবে। সেখানে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদের (ইউএনএইচআরসি) বৈঠক হওয়ার কথা। এই তথ্যচিত্র হয়তো সেই বৈঠকে প্রভাব ফেলতে পারে, ধারণা রাজনীতির কারবারিদের একাংশের।
নৃশংস গণহত্যার কথা মাথায় রেখে গত বছরই শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর উপর যুদ্ধাপরাধের দায় বর্তানোর প্রস্তাব এনেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিভাগ। কেন্দ্রে অন্যতম শরিক দল ডিএমকে-র চাপে পড়ে সে প্রস্তাব সমর্থনও করেছিল ভারত। মঙ্গলবার ডিএমকে প্রধান করুণানিধি জানান, এ বারও যেন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ইউএনএইচআরসি-এর অধিবেশনে ভোট দেয় ভারত। বলেন, “প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে যে যুদ্ধাপরাধী এই ছবি তার আরও একটা প্রমাণ।”
প্রত্যাশিত ভাবেই এই সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সেনা। তথ্যচিত্রটিকে তারা, “মিথ্যে, অর্ধসত্য, গুজব এবং জল্পনা” আখ্যা দিয়েছে। এ দিন সেনার মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার রুওয়াম ওয়ানিগাসুরিয়া বলেন, “শ্রীলঙ্কার সেনার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। .....কিন্তু তদন্ত শুরু করতে উপযুক্ত কোনও প্রমাণ আমাদের দেওয়া হয়নি।”
তরজা-পাল্টা তরজার শেষ নেই। তাতে অবশ্য ওই তিন স্থিরচিত্রের ঘোর কাটছে না কিছুতেই। নিষ্পাপ কৈশোরের বুকে পাঁচটা গুলির দাগ ভোলা আদৌ সহজ নয় যে। |