লেখার পিছনে অজানা লেখক
লেখার জন্য একাকীত্বের প্রয়োজনীতা অস্বীকার করা যায় না। নিঃসঙ্গ মনের গভীরেই বাস করে লেখার চরিত্ররা। সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় লেখকরা এই নিঃসঙ্গতার বেড়াজাল কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছেন তাঁদের পাঠকদের সামনে, বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনের মাধ্যমে। আর স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের লেখার ধরনের মতোই ভক্তদের সঙ্গে সংযোগের ধরনও আলাদা।
বিখ্যাত লেখকেরা, বিখ্যাত খেলোয়াড় বা অভিনেতাদের মতো জনসাধারণের সামনে আসতে অভ্যস্ত নন। তাঁরা অনেক সময়ই প্রচুর লোকের সামনে স্টেজে দাঁড়িয়ে খ্যাতির স্বাদ নিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। কেউ কেউ যদিও সহজেই এই সেলিব্রিটি সত্তাকে মেনে নেন। বাকিরা একটু শান্তিপ্রিয় প্রকৃতির। অপ্রয়োজনে খুব একটা মানুষের সামনে আসতে চান না।
তাই জিত থাইল (কলকাতা, কলকাতার ইরানি কাবাব, এখানকার পুরোনো সব ক্লাব আর ‘হাই লাইফ’-এর ব্যাপারে পাগল তিনি) -এর মতো লেখকও যেমন আছেন যাঁরা মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে পছন্দ করেন, তেমনই আছেন ভ্যালেরিও ম্যানফ্রেদির মতো লেখক, যাঁরা হোটেল-বন্দি থাকতেই ভালবাসেন বেশি। যদিও কোনও পাঠকের সামনাসামনি হলে কিন্তু অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার করেন।
যে সব লেখকের মানুষের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার অভ্যাসটা আগে থাকতে রয়েছে, তাঁরা অনেক নির্দ্বিধায় এই সাহিত্য সম্মেলনগুলোতে অংশ নিতে পারেন। আমার প্রজন্মের কাছে শশী তারুরের সবচেয়ে বড় পরিচয় এক জন লেখক হিসেবে। আর ওঁর লেখা ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান নভেল’ হল জীবনের সেরা কীর্তি। অনেকের মতে মন্ত্রী হিসাবে ওঁর কৃতিত্বর চেয়েও লেখনী অনেক বেশি কৃতিত্বের দাবি রাখে। ২০১২-র কলকাতা লিটারারি মিট-এর আগে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় তবে শেষ মুহূর্তে উনি জানান যে আসতে পারবেন না। তবে কথা দিয়েছিলেন যে ২০১৩-তে অবশ্যই আসবেন। শশী বোধহয় এখনও পুরোপুরি রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেননি, তাই নিজের দেওয়া কথা রেখেছেন!
ওঁর মতো তুখোড় বক্তাও কম আছে। তার প্রমাণ দিলেন লেখকদের লাউঞ্জে। পরিচিত এক মহিলাকে একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেন তিনি ট্যুইট করেননি? উত্তরে সেই মহিলা বলেছিলেন, “আমি তো ট্যুইরজিন”, যার মানে হল ট্যুইটার ভার্জিন। উত্তরে শশী বলেন যে তা হলে তিনি তো ‘ট্যুইফোম্যানিয়াক’! বোঝাই যাচ্ছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ওঁর এই রমরমা নিয়ে একেবারেই বিব্রত নন শশী। ট্যুইটার-এ মোদীবাহিনীর সঙ্গে বহু বাক্বিতণ্ডাও করেছেন। তা সে নরেন্দ্র মোদী হোক বা ললিত মোদী। এমনকী নিজেকে নিয়েও রসিকতা করতে ছাড়েননি। এক বার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মহিলাদের চটুলতা সামলান কী করে? উত্তরে বলেন, ব্যাপারটাকে উপভোগ করুন, মহিলাদের নয়। তবে খারাপ খবর এটাই যে ভারতের এই সুদর্শন রাজনীতিবিদ আজকাল আর সাহিত্য সম্মেলনে যেতে চাইছেন না। কারণ, এতে মন্ত্রী হিসাবে তাঁর কাজের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে বললেন তাঁর স্ত্রী সুনন্দা তারুর মনে করেন যেহেতু এখন তিনি এক জন মন্ত্রী তাই খুব বেশি সাহিত্য সভায় না যাওয়াই ভাল।
অনেক লেখকই রয়েছেন যাঁরা এই সমস্ত সাহিত্য সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের খুব বেশি সামনে আনতে চান না। বিক্রম শেঠ এ রকমই এক জন। আমার মনে হয় উনি তখনই কোনও সম্মেলনে যান যখন সেই সূত্রে নতুন কোনও জায়গা দেখার সুযোগ হয়! ২০১২-র জানুয়ারিতে যখন কলকাতায় এসেছিলেন, সুন্দরবন আর শান্তিনিকেতনটাও ঘুরে গিয়েছেন।

বিক্রম শেঠ

জাভেদ আখতার

শশী তারুর
বিক্রমই একমাত্র লেখক যাঁর সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যেই যোগাযোগ হয়। আমার দেখা চিরনবীন ব্যক্তিত্ব। ‘কলকাতা লিটারারি মিট’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি ছিল আইটিসি সোনার বাংলাতে। মনে আছে, উদ্যোক্তা হিসেবে আমি যখন ওঁকে নিয়ে স্টেজের দিকে হাঁটছি, উনি বারবার দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন আর নিজের ডিজিটাল ক্যামেরাটা বার করে ছবি তুলছিলেন। প্রথমে পদ্ম ফুলের আর তার পর পুকুরের কমলা রঙের মাছগুলোর ছবি তুললেন। আমি একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম কারণ, অনুষ্ঠানটা নিয়ে ওঁর মধ্যে কোনও উৎসাহের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছিলাম না। পরে কিন্তু দেখিয়ে দিলেন প্রস্তুতি কাকে বলে! পুরো অনুষ্ঠানটাতেই জমিয়ে রেখেছিলেন। একটা ডিনারে তো পকেটে দু’টো নরমপাক সন্দেশ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন! পরে সেগুলো উনি কয়েক জন অতিথিকে অফার করেন, যদিও তাঁরা সলজ্জ ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
‘কালাম’ বইটা বিক্রম ইংরাজি, বাংলা আর আরবি ভাষাতে লিখেছিলেন। চিনা ভাষাতেও লেখার চেষ্টা করেছিলেন তবে তুলি দিয়ে লেখার ব্যাপারটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক হয়ে যায় শেষমেশ।
বিক্রমকে কাছ থেকে চিনলে ওঁর ভেতরের সহজাত প্রতিভাটা বোঝা যায়। আরও বোঝা যায় যে কী ভাবে এক জন মানুষ তাঁর ভিতরের তারুণ্য আর কৌতূহলকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন সব সময়। নতুন কোনও জায়গা আর নানা ধরনের মানুষের সম্পর্কে জানার অগাধ কৌতূহল দেখেছি ওঁর মধ্যে। বিক্রমের সঙ্গে নভেম্বরে ঢাকায় দেখা হয়েছিল ‘হে ফেস্টিভাল’-এ। ইতিমধ্যেই প্রায় পুরো বাংলাদেশটাই ঘুরে ফেলেছেন। তার জন্য খরচও করেছেন বিস্তর। আমরা এত কাছে থেকেও সেটা করে উঠতে পারিনি এখনও।
আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একটা সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় চোখে ‘আই মাস্ক’ লাগিয়ে একটা কাউচে শুয়েছিলেন। লেখক বিক্রম শেঠ এমনই এক প্যাকেজ। তুখোড় প্রতিভা এবং রসবোধের এক অনন্য যুগলবন্দি।
আর এক জন হলেন জাভেদ আখতার। যিনি ভাষাকে নিজের মতো ভেঙে-গড়ে নিতে পারেন। দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার একটা অদ্ভুুত ক্ষমতা রয়েছে ওঁর। আমার ধারণা জাভেদ সাব বলার আগে হয়তো খুব বেশি হলে দশ শতাংশ দর্শক, সাদাত হাসান মান্টো সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু নিরানব্বই শতাংশ লোকই তো জাভেদ আখতার সম্পর্কে জানেন খুব ভাল করেই। ঠিক তাই জন্যই উনি যখন মান্টোকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করলেন, দর্শকদের মধ্যেও একটা কৌতূহল তৈরি হল এই মহান লেখকের সাহিত্য নিয়ে। জাভেদ আখতার মানুষ হিসেবে কিন্তু বেশ রসিক প্রকৃতির। এক বার একটি ডিনারে এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তাঁর স্বামী কোথায়? উত্তরে সেই মহিলা বলেন যে আশেপাশেই কোথাও একটা রয়েছেন। আরও বলেন ওই ঘরের পাকাচুলওয়ালা সব চেয়ে সুদর্শন ব্যক্তিটিই তাঁর স্বামী। সঙ্গে সঙ্গে জাভেদ সাবের জবাব, “আমি তো আপনার স্বামী নই!”
এক জন গুণমুগ্ধ তাঁকে এক বার বলেছিলেন ‘আখোঁ হি আখোঁ মে ইশারা হো গ্যায়া’ গানটা তাঁর খুব প্রিয়। আর সেই গানটা লিখেছিলেন জাভেদ সাবের বাবা ‘সিআইডি’ সিনেমার জন্য। উনি তখন গভীর দৃষ্টিতে সেই মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন এত সুন্দর চোখ যাঁর, তাঁর যে ওই গানের কথা পছন্দ হবে তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে! শুনতে একটু ফিল্মি কায়দার হলেও জাভেদ সাব যে অনুষ্ঠানেই যান সেখানেই মাতিয়ে রাখেন সবাইকে।
অনুরাগীদের বলেন, ওঁর দু’টো প্রিয় হিন্দি গান হল ‘আপ কি কসম’ ছবির ‘জিন্দেগিকে সফর মে’ আর ‘অমর প্রেম’ ছবির ‘কুছ তো লোক কহেঙ্গে’। তার পরই চলে যান কিশোর কুমার আর আর ডি বর্মনের প্রসঙ্গে। দুই কিংবদন্তি যাঁরা মৃত্যুর এত দিন পরেও অমর হয়ে রয়েছেন। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান গেয়ে উঠতেও শোনা যায় তাঁকে। এক বার যেমন দেখা গিয়েছিল সলিল চৌধুরীর একটা পুরোনো গান ‘মেরে খোয়াবো মে খ্যয়ালো মে’ গুনগুন করতে করতে তাঁর ঘরের দিকে যেতে। সইশিকারিরা সবিস্ময়ে দেখছিলেন তাঁকে। এক বার এক উঠতি কবি ওঁর কাছে অটোগ্রাফ চাইলে বলেছিলেন, “আমরা তো সহকর্মীর মতো। আমার সই চেয়ে বিব্রত কোরো না।”
এ বার আসব শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়। ওঁকে ব্যক্তিগত ভাবে এত পছন্দ করি তার একটা কারণ হল, ওঁর সঙ্গে যে কোনও সময় ক্রিকেট নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যায়। এই ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ দেখে বলেছেন, ‘দম নেই’। বাকি সবার মতোই উনিও সামনের অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য অপেক্ষা করছেন। আইপিএল নিয়েও খুবই আগ্রহী। ওঁর মধ্যে একটা তারুণ্য আছে, যার ফলে জীবনকে উপভোগ করতে জানেন। মাথায় সব সময় নতুন আইডিয়া গিজগিজ করছে। খুব খোলা মনের এক জন মানুষ যাঁর মুখে সব সময়েই হাসি লেগে আছে।
সমরেশদার কাছে আমার একটা খাওয়া পাওনা আছে। আমাদের মধ্যে একটা বাজি ধরা হয়েছিল। বাজিটা ছিল যে, যদি ওঁর বক্তৃতার সময় বইমেলার হল ভর্তি হয় তা হলে উনি আমাকে খাওয়াবেন আর যদি হল-এ পঞ্চাশের কম লোক হয়, (ওঁর ধারণা ছিল সেটাই হবে) তা হলে আমি খাওয়াব।
প্রতিটা কাজের একটা নিজস্ব আবেদন থাকে। তবে যে সব লেখকের লেখা পড়ে বড় হয়েছি, তাঁদের সামনে থেকে দেখতে পাওয়া এবং কাছ থেকে জানতে পারাটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে অবশ্য একটা সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করার অসম্ভব চাপও জড়িয়ে রয়েছে। এই মানুষগুলি একই সঙ্গে সাধারণ এবং অসাধারণ। এঁরা এমন কিছু বিষয়ে উচ্ছ্বসিত হন যা আমাদের মতো মানুষের চোখে অতি সাধারণ বলে মনে হয়। যেমন ধরুন একটা পদ্মফুল, বা বইমেলার থিকথিকে ভিড়ের মধ্যেও এক জন শিল্পীর একমনে তুলির টান দিয়ে যাওয়া। এ সব আমাদের চোখে সাধারণ হলেও ওঁদের কাছে অনন্য। এই ক্ষমতাই বোধ হয় সব বিষয়কে একটু অন্য ভাবে দেখতে সাহায্য করে এঁদের।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.