জমি-সমস্যার কারণে বড় শিল্পের আশাই করছে না রাজ্য। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর শিল্প উপদেষ্টা সৌগত রায় তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন রবিবার। তৃণমূলের এই সাংসদ প্রথমে কনফেডারেশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভা ও পরে সাংবাদিকদের কাছেও কবুল করলেন বড় শিল্প আসবে না ধরে নিয়েই রাজ্যের নয়া শিল্পনীতি তৈরির সুপারিশ করেছেন তিনি।
সৌগতবাবুর বক্তব্য, এ রাজ্যে জমির যা চরিত্র এবং রাজ্য সরকার যেহেতু জমি অধিগ্রহণের বিরোধী, তাই বড় শিল্পের জন্য এক লপ্তে জমি পাওয়া সমস্যার। সে কারণেই তিনি খসড়া শিল্পনীতিতে ছোট ও মাঝারি শিল্পের উপর জোর দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোড়া থেকেই ছোট ও মাঝারি শিল্পকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু বড় শিল্প ছাড়া সেই সব শিল্প কী ভাবে বাঁচবে, সে প্রশ্নের সদুত্তর মিলছে না। কারণ, বড় শিল্পের সহযোগী ও অনুসারী শিল্প হিসেবেই বেড়ে ওঠে ছোট ও মাঝারি শিল্পগুচ্ছ। আবার তাদের উপরে নির্ভরতা থাকে বড় শিল্পগুলিরও।
শিল্পে গত কয়েক দশকের খরা কাটাতে বাম আমলের শেষ দফায় উদ্যোগী হয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তৎপর হয়েছিলেন রাজ্যে বড় শিল্প আনতে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বড় শিল্পের উপর নির্ভরতার বিরুদ্ধে সরব। হস্তশিল্প মেলা হোক বা বেঙ্গল লিডস, সর্বত্রই বড় শিল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, শিল্পের গণ্ডিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন কলা-শিল্প কিংবা উৎসবকেও! তাঁর দাবি, সব ক্ষেত্রেই মূল বিষয় হল কর্মসংস্থান। যা বড় শিল্প না থাকলেও ছোট ও মাঝারি বা কলা-শিল্পের মাধ্যমেও হয়। এবং বেশিই হয়।
এটা স্পষ্ট যে মমতার ওই অবস্থান ও তাঁর শিল্প উপদেষ্টার এ দিনের বক্তব্যের পিছনে রয়েছে তাঁদের জমি-ভাবনা। বা আরও সরাসরি বললে জমি-রাজনীতি। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে গোড়া থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে তৃণমূল। কিন্তু রাজ্যে জমির যা চরিত্র তাতে বড় শিল্পের পক্ষে বিপুল সংখ্যক জমি মালিকের সঙ্গে কথা বলে বড় জমি কেনা যে প্রায় অসম্ভব, শিল্পগোষ্ঠীগুলি তা ভাল করেই জানে। এ রাজ্যে নিজেরা জমি কিনে প্রকল্প গড়তে গিয়ে দীর্ঘদিনের চেষ্টাতেও পুরো জমি জোগাড় করতে না পারার অভিজ্ঞতা হয়েছে বেশ কয়েকটি শিল্পসংস্থার। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে দল ও সরকারের বাধ্যবাধকতাই যে রাজ্যে বড় শিল্প স্থাপনের অন্তরায় এ দিন সৌগতবাবুর কথাতেও তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এ দিন।
সৌগতবাবু অবশ্য তুলেছেন রাজ্যের ঘনবসতি ও কৃষির প্রসঙ্গও। তাঁর কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে যে রকম জমির অভাব তাতে বড় শিল্প গড়তে গেলে জমি পেতে অসুবিধা হবে। পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার বাইরে অনুর্বর জমি পাওয়া মুশকিল। আর আমরা শিল্পের জন্য উর্বর কৃষিজমি নেওয়ার বিরোধী। সিঙ্গুরে যে ভাবে উর্বর জমিতে টাটাদের কারখানা হচ্ছিল, তা ঠিক নয়। তা ছাড়া জমিও শিল্প সংস্থাকেই কিনতে হবে। জোর করে জমি নেওয়া হবে না। এটা তো ঘোষিত নীতি।” সরকারি সূত্রের খবর, রাজ্যের ল্যান্ড ব্যাঙ্কের প্রাথমিক হিসেবও বলছে, ওই কয়েকটি জেলায় এক লপ্তে কিছুটা বেশি জমি আছে। তবে তা-ও বড় শিল্পের জন্য যথেষ্ট নয়।
এই পরিস্থিতির জন্য সৌগতবাবু তাঁর সুপারিশে ছোট ও মাঝারি (এমএসএমই) শিল্পের পক্ষে সওয়াল করেছেন। বলেন, “এমএসএমই-র উপরেই জোর দিতে হবে আমাদের। তাতে বেশি লোকের কাজ হবে। জমির সমস্যাও অনেকটা কমবে।” জমির প্রশ্নটা তত বড় নয়, এমন কিছু শিল্পে জোর দেওয়ার কথাও বলেন সৌগতবাবু, “যেমন পর্যটন, যেটা মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছে, তথ্য প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তির মতো নতুন নতুন ক্ষেত্র।”
কিন্তু শিল্পমহলের মতে, রাজ্যের সার্বিক বিকাশের জন্য বড় ও ছোট-মাঝারি শিল্পের মধ্যে গাঁটছড়া জরুরি। তাদের পারস্পরিক নির্ভরতাই আর্থিক বিকাশের সূত্র। বস্তুত, সে কথা মাথায় রেখেই হলদিয়ায় পেট্রোকেমিক্যালস-কে ঘিরে সার্বিক শিল্পাঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিল পূর্বতন বাম সরকার। ওই জমানার শেষ দিকে পুরুলিয়ায় একই ভাবে তিনটি বড় ইস্পাত প্রকল্পকে ঘিরে ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্য শিল্প তালুক তৈরির জন্যও অনেক জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। সিঙ্গুর পরবর্তী পর্বেও শিল্পনোনয়ন নিগম প্রায় আট হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। নিজেরা জমি অধিগ্রহণের বিরোধী হলেও শিল্পের জন্য সৌগতবাবুর দাওয়াই কিন্ত রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম বা দফতরগুলির হাতে থাকা ওই সব অধিগৃহীত জমিই।
সেই সব জমিতেও বড় শিল্প না হলে যে ছোট ও মাঝারি শিল্পের বিপদ বাড়বে, তার বড় উদাহরণ ফাউন্ড্রি শিল্প। এক সময় এ রাজ্যের ফাউন্ড্রি শিল্পের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছিল। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান ফাউন্ড্রি কংগ্রেস-এর অনুষ্ঠানে শিল্পকর্তারা বলেছিলেন, এই মাঝারি শিল্পের উন্নতির জন্য প্রয়োজন গাড়ি, ট্র্যাক্টর ও রাস্তার বাইরে চলার উপযোগী বড় ধরনের গাড়ির শিল্প। ফাউন্ড্রি শিল্পের বিকাশ চাইলে এ রাজ্যেও ওই ধরনের বড় শিল্প জরুরি।
নির্বাচনী ইস্তাহারে তৃণমূল রাজ্যে অনেকগুলি শিল্পগুচ্ছ (ক্লাস্টার) গড়ার কথা বলেছিল। কিন্ত বড় শিল্প না থাকলে সেগুলির ভবিষ্যতই বা কী দাঁড়াবে, শিল্পমহল তা নিয়ে সংশয়ে।
সৌগতবাবু জানিয়েছেন, তিনি সার্বিক ভাবে একটি পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম ও তার জন্য তহবিল গড়ার প্রস্তাব দিয়েছেন রাজ্যকে।
এ দিনের কনভেনশনে সৌগত বাবু ও রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে আপত্তির কথা ফের উল্লেখ করেন। তাঁদের দাবি, ওয়ালমার্টের মতো সংস্থা এ দেশে পা রাখলে দেশের লাভ নেই। বরং ওই সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে গোটা বিশ্বে ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। |