দু’টো ঘটনার একটা জায়গায় মিল, আর একটা জায়গায় বিস্তর অমিল।
উত্তরপ্রদেশের তাজ করিডর মামলা এবং পশ্চিমবঙ্গের গার্ডেনরিচ মামলা।
তাজ করিডরে উত্তরপ্রদেশের তদানীন্তন বসপা সরকারের শীর্ষ স্তর থেকেও সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসারকে প্রভূত চাপ দেওয়া হয়েছিল এফআইআর পাল্টানোর জন্য। সেই অফিসার মাথা নোয়াননি। কিন্তু সিবিআই কেন্দ্রীয় সংস্থা হওয়ায় মায়াবতীর সরকার তাঁকে তদন্ত-ভার থেকে সরাতে পারেনি, বেকায়দাতেও ফেলতে পারেনি। কিন্তু গার্ডেনরিচের ঘটনার জেরে তাঁকে যে পদ খোয়াতে হতে পারে, রঞ্জিতকুমার পচনন্দা সেটা মঙ্গলবার রাতেই জেনে গিয়েছিলেন। এখন রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিব পচনন্দার ‘রিপোর্টিং অথরিটি’। সদ্য অপসারিত পুলিশ কমিশনার তাই তাঁকেই জানিয়ে দেবেন যে, তিনি আর পশ্চিমবঙ্গে চাকরি করতেই চাইছেন না। প্রশাসনিক সূত্রের খবর: গত মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারি সকালে গার্ডেনরিচে হরিমোহন ঘোষ কলেজের সামনে হাঙ্গামার পরে সে দিনই সন্ধ্যায় প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা হয়েছিল তদানীন্তন সিপি’র। তাপস চৌধুরী খুনের মামলায় মোক্তারকে জড়ানোর নির্দেশ জানিয়ে চাপ আসা শুরু হয়েছিল তার আগেই।
কিন্তু টেলিফোনে সিপি ওই প্রশাসনিক শীর্ষ কর্তাকে স্পষ্ট বলে দেন, গুলিচালনার সঙ্গে মোক্তার যে কোনও ভাবেই জড়িত নয়, ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ-কর্মীদের মুখে তিনি তা জেনেছেন, এমনকী বিভিন্ন টিভি চ্যানেলও ঘটনার ফুটেজ দেখিয়েছে। ফলে আসলে কী ঘটেছে, মানুষ দেখেছেন। এ অবস্থায় মোক্তারের নামে খুনের মামলা রুজু করা সম্ভব নয়।
সূত্রের খবর: কমিশনারের এ হেন জবাব শুনে শীর্ষ কর্তা প্রচণ্ড রেগে যান। “প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশেরা সব সিপিএমের। টিভি ক্যামেরার ছবিও বিকৃত। এটা ধরে নিয়েই মোক্তারের নামে অভিযোগ লিখতে হবে।” নির্দেশ দেন তিনি। পচনন্দা এই যুক্তি মানতে চাননি। তিনি নিজের অবস্থানে অটল থাকেন। মহাকরণ সূত্রের বক্তব্য, এর পরেই শীর্ষ কর্তা ‘ফল ভাল হবে না’ বলে তাঁকে হুমকি দেন। পচনন্দা বুঝে যান, তাঁর উপরে কোপ আসতে চলেছে।
মঙ্গলবার সন্ধের ওই কথোপকথন যদি সংঘাতের ‘বিস্ফোরণ’ হয়, তা হলে তার সলতে পাকানো কিন্তু শুরু হয়েছিল এক রাত আগে। কার্যত গার্ডেনরিচের হাঙ্গামারও প্রায় বারো ঘণ্টা আগে সিপি’র সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী একটি অংশের ঠোকাঠুকির সূত্রপাত বলে মহাকরণ সূত্রের দাবি। সূত্রটি জানাচ্ছেন, ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে গার্ডেনরিচের পাহাড়পুর রোডে এক নির্মীয়মাণ বাড়িতে বোমা বাঁধতে গিয়ে ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রঞ্জিত শীলের ছেলে অভিজিৎ-সহ তিন জন জখম হন (শনিবার অভিজিৎ মারা গিয়েছেন)। ঘটনার পরে রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী তাঁর ঘনিষ্ঠ এক যুগ্ম কমিশনারকে দিয়ে কমিশনারকে বার্তা পাঠান, ‘এফআইআরে সত্যি কথা লিখলে শাসক দল তথা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। তাই এফআইআরে লিখতে হবে, অভিজিৎ-সহ ওই তিন জন কৌতূহলী হয়ে (অনলুকার্স) ঘটনাস্থলে গিয়ে বিস্ফোরণে জখম হয়েছেন।’ এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতেরা অবশ্য ততক্ষণে ডাক্তারদের কাছে কবুল করেছেন যে, তাঁরা বোমা বাঁধতেই গিয়েছিলেন। এবং ডাক্তারেরাও তা হাসপাতালে ডিউটিরত পুলিশ অফিসারদের জানিয়ে দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে আসে মন্ত্রীর বার্তা। যা শুনে পত্রপাঠ না করে দেন পচনন্দা। নিজের সিদ্ধান্তের কথা লালবাজারের অন্য অফিসারদেরও জানিয়ে দেন। এক যুগ্ম কমিশনারের কথায়, “পচনন্দা সাহেব আমাদের বলেন, জখম ছেলেরাই বয়ান দিয়েছে যে, ওরা বোমা বাঁধছিল। এর পরে অন্য ভাবে মামলা রুজু করা সম্ভব নয়।” স্বভাবতই সিপি’র ‘অবাধ্যতা’য় মন্ত্রী রুষ্ট হন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তাঁর রোষ তুঙ্গে ওঠে।
মহাকরণ-সূত্রের দাবি: মঙ্গলবারের পুলিশ-হত্যার পরে প্রভাবশালী মন্ত্রীটি বারবার ফোন করে পচনন্দাকে চাপ দিতে থাকেন, যাতে মহম্মদ ইকবালের নাম কোনও মতে খুনের মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে না-থাকে। “আমরা বুঝতে পারছিলাম, সিপি বিরক্ত হচ্ছেন। বেশ ক’বার ফোন আসার পরে শেষমেশ উনি মন্ত্রীকে জানিয়ে দেন, এ সবের থেকে মন্ত্রীর দূরে থাকাটাই কাম্য। পচনন্দা মন্ত্রীকে এ-ও পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, যেখানে বাহিনীর মনোবল টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন, সেখানে তিনি বিন্দুমাত্র আপস করতে পারবেন না।” জানাচ্ছেন এক অতিরিক্ত কমিশনার।
সিপি’র এই ‘ঔদ্ধত্য’ ওই প্রভাবশালী মন্ত্রী সহ্য করতে পারেননি বলে অভিযোগ। প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের অতি ঘনিষ্ঠ এক আমলার সঙ্গে দেখা করে তিনি পচনন্দার বিরুদ্ধে ‘রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত’ করার অভিযোগ জানিয়ে আসেন। শুধু তা-ই নয়, নিহত এসআই তাপস চৌধুরীর দেহ যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই সিএমআরআইয়ে গিয়ে তিনি কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (৩) দেবাশিস রায়কেও ইকবালের পক্ষ নিয়ে অপমান করেন বলে অভিযোগ।
পুলিশ সূত্রের খবর: ইকবালকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রী সিএমআরআইয়ে গিয়েছিলেন, দু’জনে একটা ঘরে পাশাপাশি বসেও ছিলেন। তখন দেবাশিসবাবু মন্ত্রীকে সতর্ক করে বলেন, মুন্না পাশে থাকলে তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।
অভিযোগ: মন্ত্রী তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে ঘোষণা করেন, তিনি নিজে মুন্নার উপরে নির্ভরশীল, এবং পুলিশকেও মুন্নার কথা শুনে চলতে হবে। দেবাশিসবাবু নিজে অবশ্য এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে চাননি।
মহাকরণের খবর: মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তদন্তের গতি-প্রকৃতি জানতে চেয়ে সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে তদানীন্তন পুলিশ কমিশনারকে একাধিক বার ফোন করা হয়েছিল। ইবনে-সুহানেরা কেন গ্রেফতার হল, পচনন্দা ফোনে তা বিবৃত করেন। তার পর আসে মোক্তার প্রসঙ্গ। লালবাজারের এক আইপিএসের কথায়, “পচনন্দা টেলিফোনে জানান, মোক্তারকে অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে, কিন্তু সে হাঙ্গামা বাধানোর মামলায় অভিযুক্ত। পুলিশ-খুনের মামলার সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই।” পচনন্দার বুঝতে দেরি হয়নি, এর মাসুল তাঁকে দিতে হবে। এই উপলব্ধি তাঁকে আরও জেদি করে তুলেছিল বলে পুলিশ-কর্তাদের একাংশের অভিমত। “উনি জেনে গিয়েছিলেন, ওঁর আর কিছু হারানোর নেই। যাওয়ার আগে তাই বাহিনীকে বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, আমি তোমাদের লোক। সহমর্মী।” মন্তব্য এক অফিসারের। তাপসবাবুর বাড়িতে যাওয়া, পুলিশের তহবিল থেকে পরিবারকে অর্থসাহায্য ইত্যাদির মধ্যে প্রাক্তন কমিশনারের এই মনোভাবেরই কিছুটা প্রতিফলন দেখছেন তাঁর সহকর্মীদের অনেকে। বৃহস্পতিবার বিকেলেই পচনন্দা তাঁর ভবিষ্যৎ জেনে যান। মহাকরণের আনুষ্ঠানিক নির্দেশ আসাটা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা।
মহাকরণের খবর: ওই শীর্ষ কর্তা ‘পচনন্দা অপসারণের’ সিদ্ধান্ত শীর্ষ আমলাদের জানানোর পরে তাঁদের কয়েক জন ওঁকে বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলেন। বলেছিলেন, এই সময়ে পুলিশ কমিশনার বদল করলে বাহিনীতে খারাপ প্রভাব পড়বে। উত্তরে তাঁদের শুনতে হয়, ‘পচনন্দাকে রাখলেই বাহিনীর অবস্থা খারাপ হবে।’ |