প্রতুল-সুমন-সলিলদের সুরেই চলছে শাহবাগ প্রাঙ্গণের লড়াই
শাহবাগ থেকে বলছি।
দিনভর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। কিন্তু তাতে নিভে যায়নি বসন্তের দ্রোহের আগুন। মানুষ আর মানুষ। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। ইন্টারনেট-ব্লগ-ফেসবুক ছড়াছড়ি এই দেশে। আর এই আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য এই নবীন প্রজন্মের আন্দোলন হয়তো এখনও সরকার বিরোধী নয়, কিন্তু আন্দোলনকারীরা বার বার আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘোষণা করেছেন, এ আন্দোলনে দলীয় রাজনীতির ঠাঁই নেই।
শাহবাগের নেত্রী লাকির চেহারাটা নেহাতই সাদামাটা, উঠে এসেছেন এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই গণনেত্রীকে দেখলে মনে পড়তেই পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। বলছেন, “আমরা ৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলন দেখিনি। কিন্তু ৭১-এর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে মুজিবর রহমান যে একটা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সেটা তো ইতিহাস। সেই ইতিহাস থেকে বাংলাদেশের মানুষ বিপথগামী হবেন কেন? যারা যুদ্ধাপরাধী, তাদের ফাঁসি দেওয়ার মধ্যে দিয়ে একটা নতুন অভিমুখ রচনা হতে পারে।”
রূপসী বাংলা হোটেল থেকে হেঁটে যাচ্ছি শাহবাগের দিকে। মনে হচ্ছে যে অদৃশ্য জাদুতে দেশটা হঠাৎই যেন বদলে গিয়েছে। এত দিনের পরিচিত শাহবাগ স্কোয়ার হয়ে উঠেছে ‘স্বাধীনতা প্রজন্ম চত্বর’, বাঙালির চেতনার মিনার।
রবিবার ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে
বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ। ছবি: উমাশঙ্কর রায়চৌধুরী
তারুণ্যের দেশপ্রেমের ডাক, যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির ডাক মিলেমিশে একাকার এই গণজাগরণ মঞ্চে। যদিও হলুদ বসন্তের বৃষ্টিতে এখন কালো রঙের দাপট! প্রত্যেকের মাথায় কালো ফেট্টি, হাতে কালো ব্যান্ড দু’দিন আগে মৌলবাদীদের হাতে খুন হয়ে যাওয়া তাঁদের সাথী রাজীব হায়দরকে মনে করে। চারিদিক পোস্টারে ছয়লাপ ‘২১ ফেব্রুয়ারি অমর হোক’। জাতীয় পতাকার রঙের নানা রকমের টুপি-কাপড়ও বিক্রি হচ্ছে। সবুজের মধ্যে লাল সূর্য। মনে পড়ে গেল, ৯/১১-পর নিউ ইয়র্কে দেখেছিলাম এ ভাবেই রাস্তায় শত শত জাতীয় পতাকা বিক্রি হতে।
কাল রাজীবের মরদেহ যখন চত্বরে এসেছিল, মানবসমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে এগিয়ে চলেছিল, লাউড স্পিকারে বাজছিল প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের খোলা গলার গান, ‘সব মরণ নয় সমান’। কলকাতা থেকে কবীর সুমন শাহবাগ আন্দোলনের ‘শহিদ’ রাজীবকে নিয়ে গান বেঁধে পাঠিয়েছেন, বেজেছে তা-ও। এ ছাড়া বিভিন্ন কণ্ঠে ফিরে ফিরে এসেছেন সলিল চৌধুরী, ‘...তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’। জাতীয় পতাকার পাশাপাশি এখানে কালো রঙের টি শার্ট বিক্রি হচ্ছে, বুকে লেখা, ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই/অন্য কোনও বিচার নাই।’ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজ জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। জাতীয় সংসদে হইহই করে পাশ হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন সংশোধন বিল’, যাতে ব্যক্তির পাশাপাশি জামাতে ইসলামির মতো সংগঠনকেও তোলা যাবে কাঠগড়ায়। কাদের মোল্লার ফাঁসি চেয়ে সরকারও উচ্চ আদালতে যেতে পারবে।
এই শাহবাগ আসলে ছিল মোগল বাদশাদের হাইকোর্ট এলাকা। সেখানে তারা রচনা করেছিলেন বাগান, আজ যার নাম সোহরাবর্দি উদ্যান। সেই বাগান নেই, কিন্তু রয়েছে সার সার ফুলের দোকান। সকালে ফুল কেনাবেচা হয়। সেই দোকানগুলি থেকে আন্দোলনকারীরা গোলাপ ফুল কিনে একে অন্য জনের বুকে গেঁথে দিচ্ছেন। স্থানীয় ব্যাপারী আফাজুদ্দিন বললেন, “প্রচুর টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে গত কয়েক দিনে।” মাথায় ‘একুশ’ লেখা ফুলের মুকুটও লাগাচ্ছেন অনেকেই। ছেলেমেয়েদের মুখের উল্কি, আল্পনায় লেখা‘ফাঁসি চাই’। এক জন অন্য জনের পিঠে পোস্টার সেঁটে দিলেন, তাতে লেখা‘আমাদের ধমনীতে শহিদের রক্ত।’
এক জন হাঁপানির রুগি এসেছেন ইনহেলার-এর ভরসায়! এসেছেন শিশু কোলে মা। ভাইবোন হাত ধরাধরি করে প্রতিবাদে মুখর। এক জন যুদ্ধাপরাধী শাহবাগের সন্নিকটে মুজিবর রহমানের নামাঙ্কিত ওই হাসপাতালেই আছেন। তার বাইরে উত্তাল স্লোগান ‘এ প্রজন্ম যুদ্ধ দেখেনি, রাজাকারেরাও যুদ্ধ দেখেনি। সময় এখন যুদ্ধ দেখিয়ে দেওয়ার’। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এই বিশাল জমায়েতের একটা অর্থনীতিও আছে। খেটে খাওয়া মানুষ যেন মেলা বসিয়ে দিয়েছেন এখানে। চাল গুঁড়ো করে চুলো বানিয়ে রাত জেগে পিঠে তৈরি হয়েছে। চলছে অবিরাম বিক্রি।
বিএনপি-র খালেদা জিয়া আজ ঢাকায় জনসভা করেছেন। বিএনপিও সুকৌশলে আজ এই আন্দোলনকারীদের সমর্থন করেছে। নিহত রাজীবের খুনিদের শাস্তির দাবিও জানিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, জামাত নেতারা খালেদার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও, খালেদা তাদের সময় দিচ্ছেন না। আসলে রাজীব হত্যার পর জনমত এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে, তার শরিক না হয়ে উপায় নেই কারওরই।
তবে জামাতের তাণ্ডব চলছেই। ঢাকায় ক্যাডারদের জড়ো করছে জামাত-শিবির। নেতাদের মুক্তির দাবিতে কাল দেশজুড়ে হরতাল ডেকেছে তারা। সেই হরতাল ব্যর্থ করার ডাক দেওয়া হয়েছে শাহবাগ থেকে। ব্যবসায়ীদের সংগঠন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সব দোকানপাট খুলে রাখা হবে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, স্কুল কলেজও খোলা থাকবে। পরিবহণ মালিক সমিতিও সর্বত্র বাস চালানোর কথা জানিয়েছে। রাতেই ঢাকার সর্বত্র বিজিবি-র আধাসেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আইন প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, মানুষ তৈরি, সরকারও প্রস্তুত শক্ত হাতে হরতাল মোকাবিলায়।
এই অভূতপূর্ব জমায়েতের সাক্ষী থাকলেন বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে, সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগিরের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন। ফিরে আসার সময় বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণির সঙ্গে নৈশভোজে তিনি দ্বিধাহীন ভাবে বললেন, “এই রকম গণজাগরণ অভাবনীয়!” হাসিনাও আজ ভারতের প্রশংসা করেছেন ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের কথা তুলে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়েরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকার সময় বাংলাদেশের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল, আজ তার প্রথম কিস্তিটা দিয়েছেন খুরশিদ। পদ্মার সেতু শেষ পর্যন্ত ভারতের টাকা দিয়ে করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ নেতৃত্ব। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও না কোনও ভাবে ভারতের ভূমিকাটাও উঠে এসেছে।
শাহবাগ থেকে বইমেলা হাঁটা পথ। আর একটু এগোলেই শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীনতার আগের বক্তৃতা-প্রাঙ্গণ। যারা এখানে আসছেন, তিনটিতেই যাচ্ছেন। বইমেলায় এক প্রকাশক অবশ্য অভিযোগ করলেন, “আপনারা ভারতীয় সাংবাদিক। আমাদের যত বড় আন্দোলনই হোক, ভারতের কাগজে তার প্রচার দেখি না। অথচ মিশর বা সিরিয়ায় কিছু হলে ফলাও করে ছাপেন।”
তাঁর প্রশ্ন, “আমাদের ব্যাপারে এত কার্পণ্য কেন?”
হাঁটতে হাঁটতে হোটেল ফেরার সময় একটাই কথা মনে হচ্ছিল। গোটা পৃথিবী জুড়ে নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজ এক গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক পৃথিবী গড়তে লড়াই করে চলেছেন। আন্দোলনের এই বিশ্বায়নে বাংলাদেশও আজ নিজেকে যুক্ত করে নিল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.