হলদিয়ায় বেঙ্গল লিডস্-২-এ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, এ রাজ্যে গত দেড় বছরে একটি কারখানাও বন্ধ হয়নি। আশ্বাস দিয়েছেন, রাজ্যের ছোট এবং মাঝারি শিল্পগুলিকে আরও সুযোগসুবিধা দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে এমন ছবি দেখা যায়নি সরকারি শিল্পতালুকে।
উলুবেড়িয়ার বীরশিবপুরে ‘পশ্চিমবঙ্গ শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম’ (ডব্লিউবিআইআইডিসি)-এর শিল্পতালুক যেমন। সেখানে যাঁরা কারখানা বানিয়েছেন (মোট ৬৫টি), তাঁদের এখন ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। মালিকদের দাবি, পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ক্রমশ কমতে থাকায় এবং সরকারি নজরের অভাবে সেখানে গত ছ’মাসে বন্ধ হয়েছে তিনটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। আরও একটি কারখানায় শ্রমিকদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।
শিল্পোদ্যোগীদের দাবি, কথা ছিল, নিগম শিল্পতালুকের মধ্যে রাস্তা-নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি করে দেবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ করবে, জল এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। শিল্পতালুকে ব্যাঙ্কের শাখা খোলা হবে। সর্বোপরি শিল্পতালুকে কারখানা গড়লে সরকারের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে শিল্পোদ্যোগীদের সমন্বয় এবং সার্বিক নজরদারির দায়িত্বও নিগম নেবে। কার্যত তার অনেক কিছুই হয়নি।
১৬০ একর জমিতে শিল্পতালুকটি গড়ে তোলা হয় আটের দশকের শেষে। উদ্দেশ্য ছিল, মূলত ছোট ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন ঘটানো। মোট ৭২টি প্লট। ইঞ্জিনিয়ারিং, রাসায়নিক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও প্লাস্টিক সিল্পের নানা কারখানা রয়েছে সেখানে।
শিল্পোদ্যোগীদের অভিযোগ, শিল্পতালুকটির চত্বরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নিগম এড়িয়ে গিয়েছে। গত তিন বছর ধরে শিল্পদ্যোগীরাই চাঁদা তুলে পুলিশের টহলদারির ব্যবস্থা করেছেন। শিল্পতালুকে নিকাশি ব্যবস্থা নেই। রাস্তাঘাট নিয়মিত মেরামত হয় না। রাস্তার দু’দিকে ল্যাম্পপোস্ট থাকলেও আলো জ্বলে না। প্রতি বছর জলের দাম ‘লাফিয়ে’ বাড়ানো হচ্ছে। কারখানার সামনের জমি জবরদখল হয়ে দোকান বসায়, কারখানায় ট্রাক ঢোকা বা বেরনোয় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জবরদখল উচ্ছেদ করার জন্য নিগমকে অনুরোধ করেও কাজ হয়নি। ব্যাঙ্কের কোনও শাখা খোলা হয়নি। |
নেই রাজ্য
নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া হয়নি।
•
নিকাশি বেহাল, রাস্তা মেরামত হয় না।
•
কারখানার সামনে জমি দখল।
•
রাজ্য সরকারের তরফে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেই। |
|
কাঁচামালের যোগান না থাকায় ওই শিল্পতালুকের একটি রাসায়নিক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারখানার এক কর্তার বক্তব্য, কারখানাটিতে কাঁচামাল হিসেবে এক বিশেষ ধরনের মাটি আনা হত ওড়িশা থেকে। কয়েকমাস আগে ওড়িশা সরকার মাটি দেওয়া বন্ধ করে দেয়। রাজ্য সরকার ওড়িশা সরকারের সঙ্গে কথা বলে মধ্যস্থতা করলে সমস্যা হয়তো মিটত। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। ফলে, উৎপাদন বন্ধ। শ্রমিকদের কাজ না করিয়ে মাসে পনেরো দিনের বেতন দেওয়া হচ্ছে।
সব মিলিয়ে সরকারি নজরের অভাবের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছেন বীরশিবপুরের শিল্পোদ্যোগীদের একটা বড় অংশ। তবে নিগমের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওই শিল্পতালুকে একাধিকবার গিয়েছি। এ সব সমস্যার কথা কেউ জানাননি।”
শিল্পতালুকে বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেন প্রায় ১০-১২ হাজার শ্রমিক। সিটু প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনগুলির নেতা মনোরঞ্জন মাখালের ক্ষোভ, “এই শিল্পতালুকে সরকারের নজর আছে বলে মনে হয় না।” কারখানা মালিকদের বক্তব্য, বাম-আমলে এই শিল্পতালুকের প্রতি ‘অবহেলার যে ট্র্যাডিশন’ ছিল, এখনও তাই-ই রয়েছে।
তবে নিগম এই অভিযোগ মানতে চায়নি। তাদের দাবি, শিল্পতালুকের রাস্তা নিয়মিত মেরামত করা হয়। নিকাশির জন্য নালা গড়া হয়েছিল, কিন্তু কারখানাগুলিতে আসা ট্রাক-লরির দৌরাত্ম্যে তা ভেঙে গিয়েছে। পুলিশকে বলা হয়েছে শিল্পতালুকে টহলদারি করার জন্য।
সংস্থার এক কর্তার দাবি, “প্রতি রাতে টহলদারির জন্য কারখানা মালিকেরা পুলিশের সঙ্গে কী কড়ার করেছেন, সেটা তাঁরাই জানেন। রাস্তাঘাট তৈরি এবং জল সরবরাহ করার জন্য পরিষেবা চার্জ হিসাবে যে টাকা পাওয়া যায়, তাতে কারখানা মালিকদের সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। ভূগর্ভে নিকাশি ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয় টাকা নিগমের হাতে নেই।” ওই নিগম-কর্তার সংযোজন, “সরকারি নজরদারি বা সমন্বয়ের সমস্যার জন্য নয়, কারখানাগুলি রুগ্ণ হয়ে পড়ছে মালিকদের কারণে। নিগম ওদের জন্য কিছু করতে পারবে না। তবে চাইলে, শিল্প দফতর হস্তক্ষেপ করতে পারে।”শিল্পমন্ত্রীর আশ্বাস, “কারখানার মালিকেরা আমার কাছে এলে তাঁদের সমস্যাগুলি অবশ্যই দেখা হবে।” |