বড় নেতারা বলছেন, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির অনুপ্রবেশ অপ্রয়োজনীয়। শীর্ষ নেতানেত্রীরা জোর দিচ্ছেন জনপ্রতিনিধিদের স্বচ্ছতায়। কিন্তু রাজ্যের নানা কলেজের ছাত্র সংসদে রাজনৈতিক রং নির্বিশেষে কিছু ‘বিতর্কিত’ চরিত্রের উপস্থিতি এবং তাঁদের উপরে দলীয় নেতৃত্বের ‘আস্থা’, কোথায় যেন কথায় কাজে তালকাটার ইঙ্গিত দিচ্ছে। হাওড়ার প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ, বীরভূমের রামপুরহাট মহাবিদ্যালয় বা নদিয়ার মাজদিয়া সুধীরঞ্জন মহাবিদ্যালয়ে ছবিটা এমনই।
২০১০-এর ডিসেম্বরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে ছাত্র সংঘর্ষে মারা যান এসএফআই কর্মী স্বপন কোলে। ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল বেশ কিছু তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) কর্মীর। তাঁদেরই এক জন এ বছর কলেজের টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়েছেন। রামপুরহাট মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ নিগ্রহে যে টিএমসিপি কর্মীদের বিরুদ্ধে আঙুল উঠেছিল তাঁদের এক জন বর্তমানে কলেজের ছাত্র সংসদের দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন। মাজদিয়া কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহে অভিযুক্ত এসএফআই কর্মীরাও এখনও ছাত্র সংসদের সক্রিয় সদস্য।
অনভিপ্রেত ঘটনায় নাম জড়ানো চরিত্রদের ছাত্র সংসদ পরিচালনার ভার দেওয়া হচ্ছে কেন? টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পাণ্ডার বক্তব্য, “টিএমসিপি-র যাঁরা এখন ছাত্র সংসদের দায়িত্বে রয়েছেন তাঁদের কেউ হয়তো অভিযুক্ত। কিন্তু কারও বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। সব মামলাই বিচারাধীন। পরিকল্পিত ভাবে অভিযোগ যে কেউ করতে পারে।”
এসএফআইয়ের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্রের দাবি, “বর্তমানে এসএফআই করার জন্য অনেক সময়ই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বেছে বেছে আমাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। তাই সব অভিযোগকে কখনই এক ভাবে বিচার করলে হবে না।”
রাজ্য স্তরের নীচে ছাত্র সংসদের অভিযুক্ত নেতাদেরও বক্তব্য প্রায় একই রকম। জগদ্বন্ধু কলেজের এক বিতর্কিত তৃণমূল ছাত্র নেতার (যিনি ছাত্র সংসদের পদেও রয়েছেন) দাবি, সিপিএম তথা এসএফআই তাঁকে ফাঁসিয়েছে। ২০১২-র জানুয়ারিতে, রামপুরহাট মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ নিগ্রহে অন্যতম অভিযুক্ত, বর্তমানে ওই কলেজের টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের গুরুত্বপূূর্ণ এক সদস্য বললেন, “আমরা বিতর্কিত নই। অধ্যক্ষের কাছে কলেজের উন্নয়নের দাবি জানাতে গিয়েছিলাম। অধ্যক্ষ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এর পিছনে অন্য কারও প্ররোচনাও থাকতে পারে।” ওই বছর প্রায় একই সময়ে নদিয়ার মাজদিয়া সুধীরঞ্জন মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ নিগ্রহে অভিযুক্ত এসএফআই সদস্যদের দাবি, “তৃণমূল প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে আমাদের ফাঁসিয়েছে। এখনও ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। আমাদের সদস্যদের ক্লাস করতে ও পরীক্ষা দিতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে।” ঘটনা হল, ওই এসএফআই কর্মীরাও এখনও ছাত্র সংসদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এই কলেজে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কারও বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ। কারও বিরুদ্ধে অধ্যক্ষকে হেনস্তা। এই ‘দাগ’ নিয়ে নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে যেতে সমস্যা হয়নি? টিএমসিপি ও এসএফআইয়ের বিতর্কিত নেতাদের বক্তব্য, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়ই তাঁদের ‘জনপ্রিয়তা’র প্রমাণ।
তিনটি কলেজেই নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পড়ুয়া জানিয়েছেন, ছাত্র সংসদে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতৃত্বই কাম্য। কিন্তু তাঁরা এটাও জানিয়েছেন, পড়তে এসে রাজনীতির পাকে জড়িয়ে পড়তে চান না বলে, কলেজে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে কলেজে অশান্তির জন্য তাঁরা কলেজের ছাত্রদের থেকেও বেশি দায়ী করছেন বহিরাগত রাজনৈতিক নেতাদের ‘ইন্ধন জোগানো’কে। বাম-আমলে শিক্ষাঙ্গনে ‘অনিলায়ন’ দেখা এ রাজ্যে সেই ‘ঐতিহ্য’ এখনও প্রাসঙ্গিকই থেকে যাচ্ছে। |