রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
জাস্ট যাচ্ছি
তুমি জীবনে আর কী চাও’— চিত্‌কার করে কথাটা বললেন এক ভদ্রলোক। বয়স ষাট-এর বেশিই হবে। যে মহিলাকে বললেন, তাঁর বয়সও কাছাকাছিই। এবং তিনি স্ত্রী বলেই মনে হল। না হওয়ার কোনও কারণ নেই। ভদ্রলোকের ক্লান্ত চেহারা, ঘামছেন, বেখাপ্পা বড় বোতামওয়ালা ফুলহাতা সোয়েটারটা খোলার সময় পাননি। বিগ-শপার ব্যাগ ফুটপাথে নামানো, দেখে ভারী মনে হল। বইছিলেন এত ক্ষণ। আর থাকতে না পেরে নামিয়েছেন। মুক্ত দু’হাত প্রায় আকাশে ছুড়ে দিয়েছেন রাগে, হতাশায়। যাকে বলা, তিনি একটা হাতব্যাগ আঁকড়ে ধরে এ-দিক ও-দিক দেখছিলেন, বোধ হয় কিছু খুঁজছিলেন। মাথার ক্লিপ বা কাপড় শুকোনোর ক্লিপ। হনহন করে বা হাওয়ায় ওড়া পাতার মতো অকারণে চলতে থাকা লোকজনের মধ্যে মতিচ্ছন্ন স্ত্রীর পিছন পিছন ভারী ব্যাগ নিয়ে হাঁটা মুশকিলের ব্যাপার। বোধ হয় বেশ কিছু ক্ষণ চলছে ব্যাপারটা। স্ত্রী সেটা খেয়াল না করে, নিজের তালে খরখর করে হাঁটছিলেন এটা ধরেই নেওয়া যায়। আর, ডান দিক বাঁ-দিকও করছিলেন, যাতে ভদ্রলোকের বিরক্ত হবারই কথা। যেই না স্ত্রী ‘ক্লিপ কই ক্লিপ কই’ বলে ডাইনে ঘুরেই বাঁ-দিকে ঝটকা মেরেছেন, অমনি ওঁর মাথা গরম হয়ে গেছে, বোমার মতো আওয়াজ আর ধোঁয়া বেরিয়ে পড়েছে গড়িয়াহাটের মোড়ে।
আমি এমনি এমনিই দাঁড়িয়েছিলাম। এই সব দেখছিলাম। এটা দেখে আস্তে আস্তে সরে এলাম। হাঁটতে লাগলাম ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের দিকে। দু’পাশে প্রচুর দোকান। ফুটপাথে নকল রজনীগন্ধা। শুঁকে চলে গেল একটা কুকুর। মাটির তৈরি জালা, রং করে ক্র্যাক ধরানো মার্বল-এর ফ্লাওয়ার ভাস করা হয়েছে, বিশ্রী দেখতে। দর চলছে। শাড়ির দোকানের কাচের পিছনে রোগা মেয়ে-পুতুল, দুলকি-পালকি শাড়ি পরা, ঝলমলে চোখ, যেন সত্যি-সত্যি। অথচ নাভিতে ধুলোর আস্তরণ। ওষুধের দোকানে লিপস্টিকের নানা শেড, লাল মাটি। অল্পবয়সি বিধ্বস্ত বাবা-মা, মাঝখানে ঝুলছে নাছোড়বান্দা ছেলে, একেবারে বসে পড়েছে ফুটপাথে। চিত্‌কার করছে দুর্বোধ্য ভাষায়। আঙুল দেখাচ্ছে খেলনার দোকানের দিকে, হাওয়া-ভরা স্পাইডারম্যান। কলপ-করা চুলের গোড়ায় সাদা শণ বেরনো গোমড়া জামাই জিজ্ঞেস করছেন,‘আদি হবে? আদ্দি?’ প্রায় ফুটপাথ থেকে দেওয়াল বেয়ে উঠছে পর পর পত্রিকা। জীবনে কী চাই তার সূচিপত্র। মাথা দেওয়া হচ্ছে হার্টে, কিডনিতে, নেতাজির অতীত ও রহস্যময় বর্তমানে। লোকজন আনন্দ করছে কোয়েলের বিয়েতে। এ ছাড়া বাসি হওয়া সন্ধের খবর, হাঁদা-ভোঁদা, ভাগ্যফল। থামলাম। কাছেই পাবলিক ইউরিনাল। চা খেলাম।
বাঁ-দিকে ঘুরে হনহন হেঁটে পূর্ণদাস রোড পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম চুপচাপ পাড়াটায়। লোকজন, গোলমাল, আলো কম এখানে। ঠান্ডা একটু বেশি। গাছের তলায় আগুন জ্বলছে, ইস্তিরিওয়ালা কাজ করে চলেছে। একটা মেয়ে, একটা ছেলে। একটু অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটার হাতে ট্রলি-স্যুটকেস। ফিরছে কি? না যাচ্ছে কোথাও? ছেলেটার হাত ফাঁকা, হাত দু’টো নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। বোধ হয় কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করছিল, পারেনি। কথা ফুরিয়ে গেছে। যেন দেখিইনি, এমন ভাবে ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক জোড়া নীল ছায়া পড়ল আমার শরীরে, দেখলাম। আর শুনলাম একটা কথা, মেয়েটা বলছে, ‘তুমি জীবনে আর কী চাও?’ ওদের পেরিয়ে গিয়েও মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম আর এক বার। অসহায় ভাবে এবং আমি নিশ্চিত, অকারণে, ছেলেটার হাতটা হাওয়ায় ছটফট করে উঠল শেষ বারের মতো। অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার আগে যেমন হয়।
ছবি: শুভময় মিত্র
আরও অন্ধকার, আরও চুপচাপ পাড়ায় ঢুকে পড়লাম, রাস্তার নাম জানি না। আসি না এ দিকে, অনেক পুরনো পুরনো বাড়ি। পলেস্তারা-খসা দেওয়াল, রোদে জ্বলা ময়লা দরজা, ভাঙা লেটারবক্স যাতে কেউ চিঠি দেয় না, দু’বাড়ির মাঝখানে ভিজে গলি, বেড়াল হাঁটে, মানুষ নয় সাদার্ন অ্যাভিনিউ আর রাসবিহারী অ্যাভেনিউ-এর মাঝখানে এমন পাড়া আছে জানতামই না। অনেক বাড়ির একতলায় অন্ধকার। কোথাও পর্দার আড়ালে টিভি চলছে। ফুটপাথের ওপর লোহার ইলেকট্রিক বক্স। হাত দিলাম। ধুলো ভর্তি, কিন্তু বেশ গরম। ভয় করল। ল্যাম্পপোস্টের মাথায় নীলচে আলো। তার ছায়া থেকে শ’য়ে শ’য়ে কেব্ল দৌড়চ্ছে চার দিকে। অন্ধকারে। দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু জানি কোনও তারে দৌড়চ্ছে খবর, কোথাও পিছলে যাচ্ছে সিনেমা। কোথাও দোল খাচ্ছে সাবান-শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন। থামলাম রংচটা খড়খড়িওয়ালা খোলা জানালার পাশে। দেখতে পাচ্ছি ঘরটা, পুরনো খাট, আলমারি, দেওয়ালে পুরনো ছবি। ঘরে ঢুকলেন এক বৃদ্ধা, পা টেনে-টেনে। কোনও মতে বসলেন খাটে। একটু যেন বিশ্রাম নিলেন। তার পর মুখ তুলে দেখলেন। আমাকে নজর করলেন। আস্তে আস্তে বললেন, ‘কী চাও? কেউ তো নেই এখন। সব বেরিয়েছে।’ তাকিয়ে রইলেন। আমি সরে গেলাম ওখান থেকে। উনি নিশ্চয়ই উঠে এসে জানালার গরাদ ধরে আমাকে দেখবেন না।
সাদার্ন অ্যাভিনিউতে পৌঁছে ডান দিকে ঘুরে, লেক কালীবাড়ির ফুটপাথে অনেক চটি জুতো টপকে, পুরনো ফ্ল্যাটবাড়ির নীচে এলোমেলো মোটরবাইক আর আড্ডা মারা লোকজনকে পাশ কাটিয়ে এসে পড়লাম রবীন্দ্র সরোবরের মোড়ে। রাস্তা পেরিয়ে, অন্ধকার, ঠান্ডা ফুটপাথ ধরে মেনকা সিনেমা অবধি পৌঁছে ঢুকে পড়লাম লেক-এর ভেতর। এখানে কম আসে লোকজন। ও-পাশের লেক থেকে উপচে পড়া মানুষের জায়গা এটা, বেখাপ্পা আলো লেগেছে কোথাও কোথাও। তাই নতুন করে ছায়া পড়েছে অনেক অন্ধকারে। স্লো মোশনে হাঁটছে কেউ কেউ। কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে অন্য কারও হাত। কেউ বিশেষ কথা বলছে না। অন্ধকারে কথা শোনাও যায় না বোধ হয়। কেউ একা নয় এখানে। আমিও নই। আমার সঙ্গে আসছে আমার ছায়া। নজর রাখছি। পর পর সিমেন্টের বেঞ্চ। বসে আছে কারা, চিনি না। চিনে ফেলতেও চাই না। কিন্তু কৌতূহল, কী বলছে ওরা।
কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইলাম। এক জায়গায়, নিশ্চিন্তে। কেউ জিজ্ঞেস করবে না, কেন অকারণে থেমে গেছি। অকারণে এতটা হেঁটে এসে। গাড়ির হর্ন, মোটরবাইকের ফরফর শুনতে পাচ্ছিলাম। কেউ গান শুনছে মোবাইলে, শোনাচ্ছে কাউকে, দূরে তার আলোটাও দেখা যাচ্ছিল। দেখতে পাচ্ছিলাম লেকের জলটা, নৌকো বাঁধা আছে বোধ হয়, অল্প অল্প দুলছিল সাদা ছায়াটা। যেন একটু বেশিই কাঁপুনি টের পাচ্ছিলাম ঢালু জমিটায়। ভূমিকম্প হচ্ছে কি? হলে তো সবাই বুঝতে পারছে, কেউ কাউকে ছেড়ে নড়ছে না কেন? এত ব্যস্ত? এত গভীর? এত অন্যমনস্ক? রাস্তায় বাঁক আছে একটা। এমনিতে ফাঁকা, অন্ধকার থাকে। মাঝে মাঝে গাড়ি এসে যায়, ঝাঁকে ঝাঁকে। বোধ হয় এসে গিয়েছিল, তাদের হেডলাইট রেলিং-এর মধ্যে দিয়ে ছুঁয়ে গেল সব ক’টা বেঞ্চকে। পর পর। দাঁড়ি কাটা আলোছায়া হাত বুুলিয়ে দিয়ে গেল সবার শরীরে, এতটুকু নিস্তব্ধতাকে না-ভেঙে। আলো পড়তেই যেন জেগে উঠল জোড়া মানুষরা। ও-দিকে ট্রেন যাচ্ছে নিয়ন আলোর জানালা নিয়ে, জলের ওপর ছায়া ফেলে লেক গার্ডেন্স স্টেশনের দিকে। তাই কাঁপছে জমি, কাঁপছে জল বেজে উঠল ইলেকট্রিক শাঁখ। এমন অন্ধকারের আলোয় কথা বলে উঠল প্রত্যেকে, এক সঙ্গে, একই কথা তুমি জীবনে আর কী চাও?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.