|
|
|
|
|
|
|
এক সন্ধ্যার গান |
আইজ্যাক আসিমভ
আমেরিকা |
আমার এক বন্ধু মাঝে-মাঝেই ইঙ্গিত দেয়, সে অতল থেকে সব আত্মা আহ্বান করতে পারে। অন্তত পক্ষে একটা আত্মা। এক ক্ষুদ্র আত্মা, যার শক্তি সীমিত। সেটার সম্পর্কে সে কথা বলে অবশ্য তখনই, যখন স্কচ এবং সোডার চতুর্থ গ্লাসে পৌঁছয়। এটা সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ব্যাপার: তিন গ্লাস অবধি সে আত্মা সম্পর্কে কিচ্ছু জানে না। পাঁচ গ্লাস, ব্যস, সে ঘুমে ঢলে পড়ে।
সে-সন্ধ্যায় সে একদম ঠিকঠাক নেশায় পৌঁছেছিল। বললাম, ‘সেই আত্মাকে মনে পড়ছে? সেই যে দুই সেমি লম্বা ছোট্ট আত্মা, যাকে অন্য এক জগত্ থেকে আহ্বান করে আনো? যার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে?’ ‘ওঃ!’ জর্জ বলল, ‘আজাজেল! অবশ্য এটা ওর নাম নয়। ওর আসল নামটা উচ্চারণই করতে পারি না।’ ‘ওকে কি প্রায়ই ডাকো আর কাজে লাগাও?’ ‘না, বিপজ্জনক। অত্যন্ত বিপজ্জনক। ওর শক্তিটা ব্যবহার করতে সাধ যায় ঠিকই। কিন্তু সতর্ক থাকি। আমার নীতিবোধ উচ্চ স্তরের। তাই এক বার এক বন্ধুকে সাহায্য করতে গিয়ে তাকে ডেকেছিলাম। তার পর যা ঘটেছিল, উফ, ভয়াবহ!’ ‘কী হয়েছিল?’
জর্জ বলল, আমার বয়স তখন অনেক কম। সেই সময়ে, নারী মানেই পুরুষের জীবনে একটা বিরাট ব্যাপার। এখন ভাবলে মূর্খামি মনে হয়, কিন্তু পরিষ্কার মনে করতে পারি, ‘কোন নারী’— সেটা তখন একটা ভীষণ জরুরি ব্যাপার মনে হত। আসলে, একটা থলেতে হাত ঢুকিয়ে যাকেই বের করে আনবে, মোটামুটি একই। কিন্তু সে সময়ে...। যাকগে, আমার এক বন্ধু ছিল, অ্যান্ড্রু মর্টেনসন। তুমি চিনবে না। সে বিশেষ একটি নারীর প্রেমে হাবুডুবু খেত। তার চোখে মেয়েটি ছিল দেবদূতী। সে তাকে ছাড়া বাঁচবে না। এই ধরায় সে অদ্বিতীয়া এবং তাকে ছাড়া পৃথিবী হয়ে পড়বে মোবিলে ডোবানো মাংসের মতো অখাদ্য। প্রেমে পড়লে যে ভাবে লোকে বকবক করে আর কী।
|
|
মুশকিল হল, মেয়েটি তাকে ছুড়ে ফেলে দিল এবং অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে। তার নাকের ডগা দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে অন্য এক জনের হাত ধরে চলে গেল। মর্টেনসনের কান্না দেখে ঠাট্টা করল।
মানে, সত্যি করল কি না জানি না, মর্টেনসন আমাকে এই গোছেরই আভাস দিয়েছিল। আমি বললাম, ‘বন্ধু, এ ভাবে ভেঙে পোড়ো না। মাথা ঠান্ডা করে ভাবো, সে সাধারণ একটা মেয়ে মাত্র। পথের দিকে তাকাও, সারে সারে মেয়ে চলেছে।’
সে তেতো স্বরে বলল, ‘আমি এখন চাই আমার জীবনে কোনও মেয়ে থাকবে না। অবশ্যই আমার স্ত্রী ছাড়া, ওকে তো আর সর্ব ক্ষণ এড়িয়ে যেতে পারি না। তবে কিনা, মেয়েটির জন্য কিছু করতে পারলে খুব ভাল লাগত।’ ‘হয়তো আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি’, আমি বললাম। কারণ তখন আমার হৃদয়ে বন্ধুর জন্য রক্ত ঝরছে। ‘আমি একটা আত্মাকে ব্যবহার করতে পারি, যার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। ক্ষুদ্র আত্মা।’ আমি একটা আঙুল আর বুড়ো আঙুল দিয়ে ইঞ্চিখানেক মাপ দেখালাম, যাতে সে বোঝে, এইটুকু আত্মা একেবারে বিরাট কিছু করতে পারবে না। তাকে আজাজেল-এর কথা বললাম, বিশ্বাস করল। চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। জিজ্ঞেস করল, আমি কি এমন ব্যবস্থা করতে পারব, যাতে আত্মাটি মেয়েটিকে কিছু দিতে পারবে?
বললাম, ‘পারব, যদি জিনিসটা দেওয়ার যোগ্য কিছু হয়! আশা করি, মেয়েটির শ্বাসে দুর্গন্ধ জুড়ে দেওয়া বা কথা বলার সময় মুখ থেকে ব্যাঙ বেরিয়ে আসার মতন উদ্ভট কিছু ভাবছ না!’ ‘নিশ্চয়ই নয়’, ফুঁসে উঠল সে, ‘আমায় কী ভাবো! যতই হোক, আমাকে সে দু’টি সুখী বছর উপহার দিয়েছিল। আচ্ছা, ওই আত্মা কি মেয়েটিকে অপূর্ব গানের গলা দিতে পারবে? অন্তত একটা জলসার জন্য?’ বললাম, জিজ্ঞেস করব।
মর্টেনসনের পূর্ব-প্রণয়িনী একটা স্থানীয় গির্জায় ধর্মীয় গান গাইত। শ্রোতারা ভদ্রতা করে চুপচাপ শুনত। আজাজেলের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। ও বলল, তিন ঘণ্টার জন্য মেয়েটিকে দুর্দান্ত গানের গলা দিতে পারবে। শুনে মর্টেনসন বলল, ‘চমত্কার!’
আমরা বাছলাম এমন একটা সন্ধ্যা, যখন মেয়েটি গাইবে বাখ না হান্ডেল না ওই গোছের একটা কার সুর, সোলো। অনুষ্ঠান শুরুর আগে মর্টেনসন গোমড়া হয়ে বলল, ‘আমি এটার রিহার্সাল দেখেছি। যেমন গায়, তেমনই গাইছিল। মনে হচ্ছিল, ওর যেন ল্যাজ আছে, আর কেউ সেটা আচ্ছাসে মাড়াচ্ছে।’ আগে অবশ্য ও মেয়েটার গলা সম্পর্কে ঠিক এই গোছের মতামত দিত না, বরং উল্টোটাই বলত। তবে, এখন ল্যাং খেয়েছে, তাতে মানুষের বিচারবুদ্ধি কিছুটা বদলায়। আমি বললাম, ‘ছিঃ, যাকে এত বড় একটা উপহার দিতে চলেছ, তার সম্পর্কে এই ভাবে কেউ কথা বলে?’ মর্টেনসন বলল, ‘আরে সেই জন্যই তো আমি চাই ওর গলা হোক নিখুঁত, অ্যাক্কেবারে নিখুঁত!’ |
|
মেয়েটি গান গাইতে উঠল। সে ঠিক ছোটখাটো চেহারার গায়িকা ছিল না। বেশ ভাল রকম স্বাস্থ্য ছিল, আর যখন গানের ফাঁকে শ্বাস নিতে কয়েক গ্যালন বাতাস টানত, পোশাকের অনেকগুলো পরতের মধ্যে দিয়েও বোঝা যেত, মর্টেনসন তার মধ্যে কী দেখেছিল। যাকগে, সেই সন্ধেয় যেই গান শুরু করল, মনে হল যেন একটা অন্য গলা বেরচ্ছে তার মুখ দিয়ে। মেয়েটি নিজেও যেন চমকে লাফিয়ে উঠল।
যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। যে হাতটা পেটে চেপে রেখেছিল, সেটা কাঁপতে লাগল। ওর গলা ক্রমে আরও অতুলনীয় হয়ে উঠল। যেন সে নিজেই একটা অর্গান, যা পরম শুদ্ধ লয়-তালে বেজে চলেছে। প্রতিটি স্বর একদম যথাযথ। যেন সেই মুহূর্তে ওই সুর এবং ওই স্বর জন্ম নিচ্ছে।
আর প্রতিটি ধাপে যেন আরও আরও ভাল হয়ে উঠছে ওর গলা। যে অর্গান বাজাচ্ছিল, সে হাঁ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় বাজানোও বন্ধ করে দিয়েছে। ঠিক বলতে পারব না, কারণ ওই অলৌকিক গলা শোনার সময় অন্য কোনও দিকেই মন দেওয়া সম্ভব নয়।
মেয়েটির মুখ থেকে প্রাথমিক বিস্ময়ের ভাবটা উধাও হয়ে গেছে, তার বদলে এসেছে তুরীয় আনন্দ। ওর গলা যেন নিজেই গেয়ে চলেছে, তাকে কোনও ভাবে নিয়ন্ত্রণও করতে হচ্ছে না। যে কনডাক্ট করছিল, সে পাথরের মতো স্থির, আর কোরাসে গলা মেলানোর দল বোবা।
বাকি গোটা অনুষ্ঠানটাই ছিল ওর। শুধু ওর। ও যখন গাইছিল, অন্যরা সঙ্গে গাইলেও তা একেবারে চাপা পড়ে যাচ্ছিল। আর ও যখন থামছিল, মনে হচ্ছিল আমরা অন্ধকারে বসে আছি, আলোর অভাব অসহনীয় হয়ে উঠছে।
অনুষ্ঠান যখন একেবারে শেষ হল— গির্জায় কেউ হাততালি দেয় না— তবু পাগলের মতো হাততালি পড়তে লাগল। সক্কলে উঠে দাঁড়িয়ে তালি দিতে লাগল আর দিয়েই চলল। বোঝা গেল, সবাই তালি দিয়েই চলবে, পারলে সারা রাত, যত ক্ষণ না মেয়েটি আবার গাইছে।
মেয়েটি আবার শুরু করল। অর্গানটা ফিসফিসিয়ে সংগত করল। স্পটলাইট শুধু মেয়েটির উপর। কী গাইল! কী সাবলীল! কল্পনা করতে পারবে না! আমি ভাবছিলাম, এত ক্ষণ ধরে এক একটা স্বরকে টানছে, ওর কি শ্বাস নেওয়ারও দরকার হচ্ছে না! মাত্র এক জোড়া ফুসফুস কী কসরতে বাতাসের জোগান দিতে পারছে! |
|
শেষে থামতেই হল। হাততালিও থামল। তখনই লক্ষ করলাম, মর্টেনসন চকচকে চোখে বসে রয়েছে, তার সমস্ত সত্তা দিয়ে সংগীতে মগ্ন হয়ে। তখনই আসলে বুঝতে পারলাম কী ঘটে গেছে! আমি তো সত্যি কথা বলতে গেলে, ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সরলরেখা মাত্র। কোনও রকম তঞ্চকতা আমার মধ্যে ছিল না, তাই আমি বুঝতেই পারিনি মর্টেনসনের মতলব কী ছিল!
মেয়েটি নিখুঁত গান গেয়েছে। এবং আর জীবনে কখনও নিখুঁত গাইবে না!
এ যেন, ও জন্মান্ধ ছিল, তার পর মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য দেখতে পেল যা কিছু দেখার ছিল, সব রং আর আকৃতি আর আশ্চর্য দৃশ্য, বিস্ময় ভর্তি এই মহাবিশ্বে, আর তার পর আবার অন্ধ হয়ে গেল!
তুমি তোমার অন্ধত্বকে সহ্য করতে পারো, যদি তুমি না জানো আলো কাকে বলে। কিন্তু অমন আলো আর অমন রং দেখে ফেলার পর আবার অন্ধ হয়ে যাওয়া! কেউ এটা সহ্য করতে পারবে?
মেয়েটা আর কোনও দিন গায়নি, অবশ্যই। তবে সেটাই ট্র্যাজেডির শেষ নয়। আসল ক্ষতি তো হয়েছে আমাদের, যারা অডিয়েন্সে ছিলাম। আমরা তিন ঘণ্টা শুনেছি নিখুঁততম গান, অকল্পনীয় সংগীত। তার পর আমরা আর কোনও দিন কোনও গান শুনতে পারব?
আমার একটাই সান্ত্বনা, মর্টেনসন, যে সবচেয়ে মন দিয়ে শুনেছিল, এখন একটা ইয়ার-প্লাগ পরে থাকে, কান এঁটে রাখে, একদম ফিসফিসানি ছাড়া কোনও আওয়াজই সহ্য করতে পারে না। বেশ হয়েছে! |
(সংক্ষেপিত)
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
অনুবাদ অনিশা দত্ত |
|
|
|
|
|