|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১... |
গালি চিরকালই |
বিরোধীকে কদর্য অশ্লীল ভাষায় কুরুচিকর আক্রমণ চিরদিন হয়েছে।
সংস্কৃতি, খেলা, রাজনীতি— সব ক্ষেত্রে। এ জিনিস নতুন আমদানি নয়। লিখছেন
রোহন ইসলাম |
চৈত্র সংক্রান্তি। কলকেতার কাঁসারিপাড়া থেকে সঙের মিছিল বেরিয়েছে।
বোল উঠল— ‘শহরে এক নূতন হুজুগ উঠেছে রে ভাই
অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই
এর বিদ্যাসাগর জন্মদাতা
বঙ্গদর্শন এর নেতা
এদের কথার মাত্রা অশ্লীলতা
সদা দেখতে পাই।’
এই বিদ্রুপ যে তর্কের সূত্রপাত করেছিল, তার সমাধান কিন্তু আজও হয়নি। এখন বিভিন্ন রাজনীতির কারবারির মুখে বিরোধীদের সম্পর্কে অশ্রাব্য কুশ্রাব্য কথা শুনে আমরা অনেকেই ‘কী নিচু রুচির পরিচয়!’ বলে শিউরে উঠছি। কিন্তু যুদ্ধ জমে উঠলে, সে ফুটবল ম্যাচ হোক আর কবিদের তরজা, সব্বারই রুচির আবরণটা রাগের চোটে খসে যায়। তখন চড় বা চাবুক কিছুর কমতি কোনও কালেই পড়ে না।
শোভা দে যখন সোনম কপূরের সমালোচনা করেন, তখন সোনম তাঁকে বলেন ‘পর্নোগ্রাফি-লেখিকা’ কিংবা ‘এক জন ফসিল যাঁর মেনোপজ চলছে!’ আমির খান নিজের ব্লগে লেখেন ‘শাহরুখ আমার পা চাটছে আর আমি মাঝে মাঝে ওকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছি।... শাহরুখ আমাদের কুকুরের নাম।’ সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরে করিনার সঙ্গে আর কাজ করবেন কি না জানতে চাওয়া হলে শাহিদ কপূর বলেন, ‘পরিচালক যদি আমাকে গরু অথবা ষাঁড়ের সঙ্গে অভিনয় করতে বলেন, তা হলে এক জন অভিনেতা হিসাবে আমি তা করতে রাজি।’
১৮০০ সালে আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস সম্পর্কে বিরোধী টমাস জেফারসনের পক্ষ থেকে ক্যাম্পেনে লেখা হল অ্যাডাম্স ‘একটা বীভত্স হিজড়ে গোছের চরিত্র, যাঁর পুরুষের বলিষ্ঠতাও নেই, নারীর নম্রতাও নেই।’ আবার জেফারসন সম্পর্কে পাল্টা মন্তব্য এল ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের থেকে: ‘উনি ক্ষমতায় এলে এমন আইন করবেন, আমাদের বউ ও মেয়েরা বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য হবে।’
|
|
১৮২৮-এ প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সি অ্যাডাম্স সম্পর্কে ডেমোক্র্যাটরা বলল, উনি রাশিয়ার জার-এর জন্য মেয়ে জোগাড় করে দিতেন, দালাল। তার উত্তরে আ্যাডাম্স শিবির বলল, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বারো জন রেড ইন্ডিয়ানের মৃতদেহ তারিয়ে তারিয়ে ব্রেকফাস্টে খেয়েছেন, আর ওঁর মা বেশ্যা, স্ত্রী ব্যভিচারিণী।
১৮৩৬-এ কংগ্রেসম্যান ডেভি ক্রকেট বিরোধী মার্টিন ভ্যান বুরেন সম্পর্কে বলেন, ও তো গোপনে মেয়েদের পোশাক পরে থাকে! ১৮৭৬-এ রাদারফোর্ড হেস-এর বিরোধীরা বলতে শুরু করেন, তিনি নিজের মা’কে রাগের মাথায় গুলি করে মেরেছেন। একটা নির্বাচনের আগে এব্রাহাম লিঙ্কনের বিরুদ্ধে কাগজে লেখা হল, তিনি দশ দিনে এক বার মাত্তর মোজা পাল্টান! সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে ১৯৬৪-এ ব্যারি গোল্ডওয়াটারের বিরুদ্ধে লিন্ডন জনসন শিবিরের টিভি-বিজ্ঞাপন ‘ডেজি গার্ল’। তাতে দেখানো হয় একটি মেয়ে বিশাল মাঠে দাঁড়িয়ে ডেজি ফুল ছিঁড়ে পাপড়িগুলো গুনছে, হঠাত্ বিরাট বোমা পড়ে মাঠটায়, আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মর্মার্থ: ব্যারিকে ভোট দিলে আপনার সন্তান রাশিয়ার ফেলা পারমাণবিক বোমায় মারা যাবে!
তবে শুধু আমেরিকানরা কাদা ছোড়ে না। ২০০৬-এ রাষ্ট্রপুঞ্জে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি উগো চাভেস বললেন জর্জ বুশ সম্পর্কে, ‘কালকে শয়তান (Devil) এসেছিল এখানে।’
আগের দিন বুশ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। চাভেস জুড়ে দিলেন, ‘এখনও এই জায়গাটায় সালফারের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে!’ ১৯৯৩-এ কানাডায় সাধারণ নির্বাচনের আগে লিবারাল নেতা জাঁ শ্রেতিয়েঁ-র মুখের আংশিক পক্ষাঘাতকে নিয়ে শুরু হয় বিরোধী শিবিরের ক্যাম্পেন, তাঁর মুখের বিভিন্ন ছবির স্থিরচিত্রের পিছনে ভয়েস-ওভারে বলা হতে থাকে, ‘এ হবে আমাদের রাষ্ট্রপতি?’ কানাডাতেই ২০০৮-এ কনজার্ভেটিভ দলের ক্যাম্পেনে দেখানো হল, (অ্যানিমেশন ব্যবহার করে) বিরোধী নেতা স্তেফানে ডিয়ন-এর গায়ে একটা পাখি বিষ্ঠা ত্যাগ করছে। |
|
১৯৪৭-এ ইংল্যান্ডের সংসদের বিরোধী দলনেতা উইনস্টন চার্চিলকে জিজ্ঞেস করা হয়, স্ট্যানলি বল্ডউইনের আশি বছর পূর্ণ হচ্ছে, হোক তিনি আপনার রাজনৈতিক বিরোধী, আপনি শুভকামনা জানাবেন না? চার্চিল বললেন, ‘আমি ওঁর অমঙ্গল কামনা করি না, কিন্তু উনি আদৌ না জন্মালেই খুব ভাল হত।’
মহাভারতে যুদ্ধের সময় অভিমন্যু দুঃশাসনকে বলেছেন ধর্মত্যাগী কটুভাষী নিষ্ঠুর মূর্খ, কর্ণ ভীমকে মাকুন্দ বলে গাল দিয়েছেন। প্রাচীন গ্রিসের খ্যাত কমেডি রচয়িতা অ্যারিস্টোফেনিস নিজের নাটকে ভূরি ভূরি কুরুচিকর মন্তব্য করেছেন সমকালীন নাট্যকারদের সম্পর্কে। তাঁদের ব্যাঙ-ও বলেছেন। প্রথম শতাব্দীতে রোমে স্যাটায়ার লিখতেন সেনেকা, জুভেনালরা। সেই সব লেখায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের নোংরা খিস্তিখেউড় করা স্বভাবে পরিণত হয়েছিল তাঁদের। মধ্যযুগে কম যাননি দান্তেও। ‘ডিভাইন কমেডি’র প্রথম অংশ ‘ইনফার্নো’তে নিজের শত্রুদের নরকের বিভিন্ন কক্ষে ঠাঁই দিয়েছিলেন। যমদূতেরা সেখানে তাঁদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালিয়েছিল!
প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলায় কবিয়াল রামপ্রসাদ ঠাকুর সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বী কবিয়াল রাম বসুকে ছড়ায় যে ভাষায় বিঁধেছিলেন তা উপভোগ করেছিলেন নবকৃষ্ণ দেবরা।
‘নাই কো রাম বোসের এখন সেকেলে পৌরষ,
এখন দল করে হয়েছেন রাম বোস রাম কামারের অণ্ডকোষ’।
আর উনিশ শতকে গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ‘সম্বাদ রসরাজ’ ঈশ্বর গুপ্তকে ‘সমকামী’ বলে খিল্লি করে ছড়া কাটল: |
|
‘শুন হে ঈশ্বরদাস জিজ্ঞাসি তোমায়
যথার্থ মনের কথা বলিবে আমায়
... পত্নীর সুরম্য স্থান কিসে দেখ মন্দ
ভালবাস কি কারণ শিশু গুহ্য গন্ধ
কি জন্য ছাড়িলে পত্নীসহ সুখরতি
কি হেতু বালকগুহ্যে হইয়াছে মতি
কি কারণ দারাসহ আলাপে প্রমাদ
শিশুগুহ্য লেহনেতে এত কি আস্বাদ
মহাপাপী নরাধম গুপ্ত কর্তাভজা
মজাইয়া শিশুগণ ভোগ মারে অজা।’ |
|
|
এর পর আর এখনকার ফিল্ম-পরিচালক কাগজ-ইন্টারভিউয়ে অন্য পরিচালকদের বাপান্ত করলে সেটা খুব ‘আধুনিক নীতিহীনতা’ মনে হয় কি?
৯/১১-র মর্মান্তিক ঘটনার ঠিক তিন সপ্তাহের মধ্যেই মার্কিন জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা গিলবার্ট গটফ্রিড রসিকতা করেন: ‘ঘটনার দিন আমি একটা প্লেন ধরার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সরাসরি গন্তব্যস্থলে যাচ্ছে এমন কোনও প্লেন পাইনি। ওরা বলেছিল, আগে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এ থামতে হবে!’ যখন সুনামি আছড়ে পড়েছে জাপানে, গিলবার্ট টুইট করে বসলেন, ‘জাপান সত্যিই অনেক উন্নতি করেছে। তাঁরা এখন বিচে যান না। বিচই বরং তাঁদের কাছে চলে আসে!’
মহিলা অধিকার সুরক্ষা কর্মী সান্দ্রা ফ্লুক একটি আলোচনাসভায় কলেজ-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় গর্ভনিরোধক দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। মার্কিন রাজনৈতিক সমালোচক তথা একটি জনপ্রিয় রেডিয়ো টক শো-র হোস্ট লিম্বুয়া লিম্ তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এই বেশ্যাটি এত বার সহবাস করেছেন, অথচ তাঁর নিজের জন্মনিয়ন্ত্রণের খরচ মেটানোর সামর্থ্য নেই! তাই ওবামা আর পোপের কাছে সেই খরচ মেটানোর দাবি তুলেছেন!’ ২০১২ সালে নির্বাচনের মুখে একটি বিল প্রসঙ্গে আমেরিকায় ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী গর্ভপাত-অধিকার নিয়ে বিতর্ক হয়, মিসৌরির রিপাবলিকান প্রতিনিধি টড অ্যাকিন বলেন, ধর্ষিতা গর্ভবতী হলে তা ‘বৈধ ধর্ষণ’। ইন্ডিয়ানার সেনেট প্রার্থী রিচার্ড মারডক বলেন, ‘ধর্ষণের ফলে মেয়েদের গর্ভবতী হওয়া আসলে ঈশ্বরেরই অভীপ্সা।’
ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ চলাকালীন ভারতীয় উইকেটকিপার পার্থিব পটেল একটি ক্যাচ মিস করলে কমেন্ট্রি বক্সে প্রাক্তন ইংল্যান্ড অধিনায়ক নাসের হুসেন বলেন, ‘ভারতীয় মধ্যে তিন-চার জন ভাল ফিল্ডার রয়েছে। তবে মাঠে এক-দু’জন বাঁদরও ফিল্ডিং করছে।’ পাশ থেকে সঞ্জয় মঞ্জরেকর ‘বাঁদর’দের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি মুনাফ পটেল, প্রবীণ কুমার ও পার্থিব পটেলের নাম করেন।
শেষের গল্প আমাদের বিধানসভা অধিবেশন কক্ষের। পঞ্চাশের দশক। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির এক নেত্রী নিজের সিটে বসলেন। কিন্তু এ কী! ওখানে রাখা ছিল আলতা। তাঁর পিছনে লেগে গেল। বুঝতে পেরেই উঠে দাঁড়ালেন মহিলা। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন শাসক দল কংগ্রেসের বীরপুঙ্গবেরা। সঙ্গে ছিল হাততালিও।
বাংলা আছে সেই বাংলাতেই! |
ছবি: সুমন চৌধুরী
|
|
|
|
|
|