একটা সময় ছিল যখন দুনিয়া জুড়েই ভোট দেওয়ার বয়স ছিল ২১। ক্রমে বিভিন্ন দেশ সেই বয়ঃসীমা নামিয়ে আনল ১৮ বছরে। ১৯৪৬ সালে চেকোস্লোভাকিয়াই প্রথম। ১৯৫৮-য় দক্ষিণ আফ্রিকা। তার পর হুড়মুড় করে একগাদা দেশের যোগদান। ১৯৭০-এ ব্রিটেন, কানাডা, জার্মানি। ১৯৭১-এ নেদারল্যান্ডস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কেন এই পরিবর্তন? মূল যুক্তি একটিই। পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে তাল রেখে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সীমারেখাটা মাঝে মাঝেই পাল্টাতে হতে পারে। কখন শিশুবেলা শেষ হয়ে ‘বয়ঃ’ সত্যিই ‘প্রাপ্ত’ হওয়া যায়, সেটা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিকের উপর। আধুনিক কালে বড় হওয়াটা তাড়াতাড়ি ঘটে, তাই ভোটাধিকারও তাড়াতাড়ি। এই যুক্তি অনুসারেই ভারতও ভোটাধিকারের বয়স ২১ থেকে নামিয়ে আনল ১৮’য়। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হল ১৯৮৯ সালের ২৮ মার্চ।
এগারো বছর পর, ২০০০ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধির ইতিহাসে ঘটল এক গুরুতর সংশোধন: জুভেনাইল জাস্টিস (কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অব চিলড্রেন অ্যাক্ট) অনুসারে প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্কের সীমারেখা ১৬ থেকে উঠিয়ে ১৮ করা হল। এখন থেকে ১৮ বছরের কমবয়সির অপরাধ ‘নিরীহ’ গণ্য হবে। অর্থাৎ ভোটের ক্ষেত্রে বয়সসীমার নিম্নগতি, কিন্তু দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে বয়সসীমা ঊর্ধ্বগামী! বোঝা গেল, রাষ্ট্রের মতে, অধিকারের ক্ষেত্রে বয়সটা তাড়াতাড়ি আসে, কিন্তু অপরাধ করা বা না-করার দায়িত্বের ক্ষেত্রে ‘বয়ঃ’ বস্তুটা প্রাপ্ত হওয়া যায় একটু ধীরেসুস্থে! |
এই আইনেরই আওতায় পড়ল এ বারের দিল্লি ধর্ষণ-কাণ্ডের ষষ্ঠ অভিযুক্ত ছেলেটি, গত ডিসেম্বরে মারাত্মকতম অপরাধটি সাধনের সময় যার বয়স ছিল ১৭ বছর ছয় মাস! সুতরাং বাকি পাঁচ জনের জন্য যখন বরাদ্দ হল কঠিনতম শাস্তি ফাঁসি, মাত্র ছয়টি মাসের কল্যাণে বেঁচে গেল সেই ‘বালক’। তার ক্ষেত্রে বরাদ্দ দাঁড়াল জুভেনাইল জাস্টিস, যার সর্বোচ্চ শাস্তি সংশোধনাগারে তিন বছর, সাকুল্যে ১০৯৫ দিন। অথচ নানা রকম প্রমাণসাবুদ জানাচ্ছে, দামিনীর উপর অত্যাচারে নৃশংসতম পদক্ষেপগুলি এই ‘বালক’ই নিয়েছিল। দেশ জুড়ে আবেগ তাই তীব্র বেগে বহমান: এই ছেলেটিরও ফাঁসি চাই, আইন পাল্টানো হোক। আইনের পুনর্বিবেচনায় শেষে মত দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ‘জুভেনাইল’ বিষয়টা নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু একটা ভয়ের বিষয়ও থেকে যায় বটে। এত গুরুতর বিষয়ে এমন হুড়োহুড়ি করে আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত নেওয়া কি ঠিক? একটি বিশেষ ঘটনায় এক বিশেষ ব্যক্তির উপর প্রচণ্ড রাগ হয়েছে বলেই দেশের আইনটাকেই রাতারাতি পাল্টে ফেলব? ‘ফাঁসি চাই’ দাবি তুললেই হল? আইনের পিছনে যে নীতি বা আদর্শটাকে নেড়েচেড়ে দেখব না?
সেই নাড়াচাড়াটা হলেই বোঝা যেত, বয়স কমিয়ে ১৬ করার দাবিটির মধ্যে একটা বড় সমস্যা আছে। দিল্লির এই বিকৃতমনা ছেলেটির বয়স সাড়ে সতেরো, তাই আমরা উঠেপড়ে বলছি, দণ্ডযোগ্যতার বয়স ১৬ বছরে নামানো হোক। কী হবে যখন আবার কখনও এমনই কোনও অপরাধ ঘটাবে সাড়ে পনেরোর কোনও ছেলে? আমরা আবার নতুন করে কোমর বেঁধে লাগব, বয়সটাকে ১৬ থেকে ১৪-য় নামাতে? এটা কি সুস্থ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া? সুবিবেচনা?
বয়স তো আসলে শেষ পর্যন্ত একটা সংখ্যাই! তা হলে কী করে এত নিশ্চিত হওয়া গেল বয়সটা ১৬ হলেই সব সমস্যা শেষ? এই তো সে দিন পড়লাম, দক্ষিণ ভারতে একটি দশ বছর ছেলে তার আট বছরের খেলুড়ে বান্ধবীর উপর রেগে গিয়ে তাকে হত্যা করেছে, কিন্তু সেই হত্যার উপায় ঠাউরেছে ভারী বুদ্ধি করে। প্রথমে কন্যাটির মুখে মাটি ঢুকিয়ে তার কণ্ঠরোধ করে তার পর কুপিয়ে মেরেছে। আইন অনুসারে এর অপরাধও নিশ্চয়ই ‘নিরীহ’ গোত্রভুক্ত। আজ জুভেনাইল জাস্টিস আইনের সীমা নামিয়ে ১৮ থেকে ১৬ করলেও এই ‘ঠাণ্ডামাথা’ বালকটির কোনও সাজা হবে না, কিন্তু যদি ‘সাজা’ জিনিসটার এতটুকুও অর্থ থাকে, তবে কিছু সাজা তার পাওনা ছিল। ফলে বয়স বস্তুটা নিতান্ত আপেক্ষিক, অর্থহীন। অর্থ শুধু এটুকুই হিসেব অনুযায়ী, এ দেশে জুভেনাইল জাস্টিস-এ যাদের বিচার হয়, তার একটা বিরাট অংশের (২০১১-য় ৬৪ শতাংশের) বয়স ১৬ থেকে ১৮, তাই দুই বছর কমালেই আরও বহু অপরাধী ভারতীয় দণ্ডবিধির আওতায় এসে দণ্ডযোগ্য হয়ে পড়বে। কিন্তু অপরাধীর সংখ্যা বাড়ানোই কি আমাদের লক্ষ্য? না কি অপরাধীর অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে তার শাস্তিবিধান হোক, এটাই আমরা চাই?
যখন ‘জুভেনাইল’-এর বয়ঃসীমা কমিয়ে ১৬’য় আনা হয়, যুক্তি শোনা গিয়েছিল, দেশের শিশুদের ভবিষ্যতের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চায় ভারত। যুক্তিটি বড্ডই গোলমেলে। যে বিকৃতমনা ছেলেটি জেলে যাওয়ার বদলে সংশোধনাগারে যাচ্ছে, এবং সংশোধনের নাম করে বিচিত্র নৈরাজ্যের মধ্যে তিনটি বছর কাটাচ্ছে, তার দায়িত্ববোধ কি সত্যিই জাগ্রত হয়? আমাদের দেশের সংশোধনাগারগুলিতে সচরাচর কোনও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক থাকেন না, দেখভালের জন্য যথেষ্ট কর্মী থাকেন না। কখনও ফুটন্ত জল অন্যের গায়ে ঢেলে, কখনও ছুরি দিয়ে পরস্পরের পিঠ রক্তাক্ত করে, কখনও জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি গায়ে চেপে ধরে বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে ‘দায়িত্ববোধ’ জাগায়। অপরাধীদের মানবিক পরিস্থিতিতে রাখাটাই যদি যুক্তি হয়, এর থেকে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়াই সঙ্গত ছিল। ফলত এবং দ্বিতীয়ত, জুভেনাইল হোম থেকে বেরোনোর পর এদের অপরাধপ্রবণতা কমার প্রমাণও নেই। তৃতীয়ত, নৃশংসতম অপরাধ করলেও যদি কেবল বয়সের কারণে তাদের শাস্তি না হলে কি দায়িত্ববোধ জাগে? যে সপ্তদশবর্ষীয় ছেলে কোনও মেয়ের যোনিতে রড ঢুকিয়ে অন্ত্র ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে, নিজের হাতে অন্ত্র ‘ছিঁড়ে বার করে’ উল্লসিত হয়, কঠোর শাসন ছাড়া তার মানসিক উত্তরণ কি সত্যিই সম্ভব?
এবং চতুর্থত: ঠিক কোন যুক্তিতে ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেই অপরাধীর সংশোধনযোগ্যতা শূন্য হয়ে যায়? যে পাঁচ অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড হল এ বার, কী করে জানলাম তারা সকলেই সংশোধনের অযোগ্য, মন-চিকিৎসার অতীত ছিল? সাড়ে সতেরোয় সংশোধনযোগ্য, আর সাড়ে আঠারোতেই সংশোধন-অযোগ্য? কত বয়স ছিল দস্যু রত্নাকরের?
অপরাধকে ঘৃণা, অপরাধীকে সংশোধন: এই আদর্শের বিকল্প নেই, হতে পারে না। কিন্তু সেই আদর্শ মেনে চলার জন্য আইনের মনটাকে একটু খোলা রাখা দরকার। ১৮ কিংবা ১৬ বছরের ফাঁদে তাকে ধরেবেঁধে পিষলে চলবে না। আবার, অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী অপরাধীর বিচার করো, এই যুক্তিও যথেষ্ট বাস্তবসম্মত, এই যুক্তি অনুসারে চলতে হলেও আইনের খাঁচাটাকে ঢিলা রাখা দরকার, একটা বিশেষ সংখ্যার ‘কাট-অফ’ যান্ত্রিক ভাবে মানা যাবে না। ‘জুভেনাইল’ অংশটাকে যথেষ্ট সীমিত করে, তার বাইরে প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রই আলাদা ভাবে বিশিষ্ট ধরে নিয়ে বিচার করতে হবে।
বিচারশাস্ত্র-মতে, শাস্তিদানের জন্য অপরাধের প্রকৃতি (ক্যাপাসিটি) ও অপরাধীর মানসিকতা (কাল্পেবিলিটি): দুটোই সমান গুরুতর, দুটোই বিচার্য। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে অর্থাৎ মানসিকতা বিশ্লেষণের সহায়ক হয়ে উঠুক বয়সের হিসেব। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে বয়সটাকেই মানসিকতার শেষ কথা হিসেবে ধরলে খুব বড় ভুল হয়ে যায়। ‘বয়স’ জিনিসটাকে যে আইন এমন সরলীকৃত, ‘গিভ্ন’ বা প্রদত্ত হিসেবে দেখে, সেই আইন যে নিজেই এখনও ছেলেমানুষ! |