স্বেচ্ছাবসর অদ্ভুত ঘটনা। সচিন তেন্ডুলকর তাহা লইতেছেন না বলিয়া বহু মানুষ ভাবিয়া আকুল, পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট তাহা লইয়াছেন বলিয়া অধিক সংখ্যক মানুষ স্তম্ভিত ও হতাশ। অবসর যদি পূর্বনির্ধারিত নিয়মের উপর নির্ভর না করে, তাহা লওয়া অতি কঠিন। করণিক ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানের দিন দুঃখ পাইতে পারেন, অবসর-জীবনকে ঘৃণাও করিতে পারেন, কিন্তু সেই শোকের মধ্যে তাঁহার নিজ দায় নাই। কিন্তু যে মানুষটি নিজের ইচ্ছায় নিজ-নির্ধারিত ক্ষণে বহু দিনের কর্মস্থল ছাড়িয়া, স্বনির্বাচিত কর্মক্ষেত্র ছাড়িয়া, সকল প্রাণশক্তি ও জীবনানন্দ যে কর্মে নিয়োজিত ছিল তাহা ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছেন, অবশিষ্ট জীবন তাঁহাকে সেই অবসান-সিদ্ধান্তের দায়িত্ব বহন করিতে হইবে। কর্মের যে ক্ষেত্রগুলিতে নৈপুণ্যের প্রকাশ স্পষ্ট ও বস্তুগত ভাবে বিচার করা যায়, সেইগুলিতে অবসর লওয়া তবু অপেক্ষাকৃত সহজ। যেমন ক্রীড়াক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে রানের সংখ্যা বা ক্রমান্বয় পরাজয় প্রত্যক্ষ বিবৃতি দিবে: সময় হইয়াছে, শরীরগত সত্যের নিকট আকাঙ্ক্ষার অস্ত্র সমর্পণের দিন আগত। কিন্তু যে ক্ষেত্রগুলিতে কীর্তি এমনই আপেক্ষিক, ব্যক্তি উত্তম কর্ম করিতেছেন, না অধম কর্ম করিতেছেন তাহাই বুঝিতে অধিকাংশ মানুষ অপারগ, সেইগুলি হইতে স্বেচ্ছাবসর প্রায় অসম্ভব। কবি বয়স হইলেই খারাপ লিখিবেন: তাহার অর্থ নাই, চলচ্চিত্রকার বয়সের সহিত প্রতিভা হারাইবেন: ইহাও স্বতঃসিদ্ধ নহে। এইগুলির উৎকর্ষ মাপার স্পষ্ট উপায় নাই। ফলে কে ভাল লিখিতেছেন বা বুঝিতেছেন ইহা লইয়া সর্বদাই তর্ক চলিবে, আর ব্যক্তিটি স্বয়ং নিজেকে সদাই চমৎকার ভাবিয়া চলিবেন এবং মৃত্যুর পূর্বে তাঁহার নিজ বোধ প্রকাশ্যে জাহির করিবার অভ্যাসে ছেদ পড়িবে না, ইহাই প্রচলিত। পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই শিল্পী রহিয়াছেন, যিনি কোনও বাধ্যতা ব্যতিরেকে, নিজেকে পূর্ববৎ কুশলী মনে করিতেছেন না বলিয়া জ্যোতির্বলয় হইতে সরিয়া গিয়াছেন। এই প্রেক্ষিতে পোপের অবসর অধিক আশ্চর্য। গত ছয় শত বৎসরে এই রূপ ঘটনা ঘটে নাই। পোপ আমৃত্যু তাঁহার আসনে বসিয়া ‘রাজত্ব’ করেন, অনুগামীর সংখ্যা ও প্রভাবের পরিধি সম্যক উপলব্ধি করিলে তাঁহাকে রাজা না ভাবিয়া উপায় নাই। ঐতিহ্য যে ক্ষেত্রে অবসরের প্রশ্নটিকেই উত্থাপিত হইতে দেয় না, সেই ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ক্ষমতা কেহ স্বেচ্ছায় ছাড়িয়া দিতে পারেন, ইহা কাহারও সহজে বিশ্বাস হইতেছে না। বিস্ময় সন্দেহ অনুমানের তরঙ্গ উঠিতেছে। পঁচাশি বৎসরে তাঁহার শরীর ও মন গুরুদায়িত্ব বহন করিতে পারিতেছে না, এই অতীব বিশ্বাস্য বাক্যেরও নেপথ্যে ভ্যাটিকানের গোপন কাহিনি-সন্ধান চলিতেছে। কারণ: ত্যক্ত ক্ষমতার বিশালতা, ঔজ্জ্বল্য। এই প্রবল আলোড়ন বলিয়া দেয়, ব্যক্তির আত্মমূল্যায়ন ও স্বনিবৃত্তি আজও কী ব্যতিক্রমী গুণ, এই সতত বিস্ময়পূর্ণ জগতেও কী বিরল! অন্য কেহ বলিবার পূর্বে এক ব্যক্তি নিজেকে অক্ষম বলিতেছেন এবং নিজেকে সরাইয়া লইতেছেন, ইহা গ্রহণ করিতে আমাদের তীব্র অসুবিধা হইতেছে, চতুর্দিকে গদি আঁকড়াইয়া ঝুলিয়া থাকা প্রাণিগণের পটভূমিতে অবাস্তব মনে হইতেছে। এই পোপ রক্ষণশীল ছিলেন, বিপ্লব কিছু করেন নাই, কিন্তু এই অতীব বিনয়ের পরাকাষ্ঠাস্বরূপ যে কর্মটি তিনি অবসর ঘোষণার মাধ্যমে করিলেন, তাহাই তাঁহাকে ভাস্বর করিল। যদি আমাদের রাজনীতিবিদরা এই শিক্ষার সিকি ভাগ লইতেন, পৃথিবী কী নিরুপদ্রব হইত! |