যে ফর্মুলা কয়েক দশক ধরে তাদের জিতিয়েছিল, সেই ফর্মুলাতেই কলেজে কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) কাছে ধরাশায়ী হচ্ছে এসএফআই। সন্ত্রাস, গায়ের জোরই এর একমাত্র উপাদান। জেলার কলেজে তো বটেই, খাস কলকাতাতেও এই চিত্রের ব্যতিক্রম ঘটেনি। বদলেছে শুধু দু’দলের অবস্থান। আগে এসএফআই ছিল শাসক দলের ছাত্র ইউনিয়ন। এখন সেখানে টিএমসিপি।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গোলমাল চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে। শহরের অন্য অনেক কলেজে টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে অভিযোগ, কোথাও বাধা দেওয়া হচ্ছে মনোনয়ন তোলার সময়ে, কোথাও তা তুলতে দিলেও বাধা পড়ছে জমার ক্ষেত্রে। নেতা-বিধায়কদের উপস্থিতিতেই এ সব চলছে। এসএফআই-এর দাবি, স্বচ্ছ নির্বাচন হলে তারা জিততে পারবে না বুঝেই সন্ত্রাস করে কলেজ দখল করছে টিএমসিপি। টিএমসিপি মানতে নারাজ। অভিযোগ উঠছে, ২০১১-এ তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এসএফআই-এর প্রচলিত কলেজ-দখলের ছকে চলছিল টিএমসিপি। ওই বছরের শেষেই ছিল ‘পরিবর্তনের’ পরে ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচন। অন্য দলকে মনোনয়নপত্র তুলতে না দেওয়ার মতো অভিযোগ আসতে শুরু করেছিল সে বার থেকেই। এক বছরে সে জাল ছড়িয়েছে আরও দূর। কলকাতায় এখনও সব কলেজে নির্বাচনী প্রক্রিয়া পুরদমে শুরু হয়নি। যে ক’টি জায়গায় হয়েছে, তাতেই নানা কলেজ রণক্ষেত্র।
মনোনয়নপত্র তোলাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়েছে সল্টলেকের বিধাননগর কলেজ (বিএনসি), দমদমের সরোজিনী নাইডু কলেজ। দু’ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে গোলমালে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। বিধাননগর কলেজে বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত ছিলেন সক্রিয় ভূমিকায়। সরোজিনীতে স্থানীয় কাউন্সিলর মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য। বিএনসি-তে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছে এসএফআই। আর নাইডু কলেজে বিরোধীরা জমাই দিতে পারেনি মনোনয়নপত্র। অতএব, দু’ক্ষেত্রেই জয়ী টিএমসিপি। একই রকম গোলমালে উত্তপ্ত হয় ডিরোজিও কলেজও। এসএফআই-এর অভিযোগ, দমদম মতিঝিল (দিবা), জয়পুরিয়া কলেজেও মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেনি তারা।
নির্বাচন হয়েছে বিদ্যাসাগর কলেজের সকাল, দিবা ও সান্ধ্য বিভাগে। সব ক্ষেত্রেই জয়ী টিএমসিপি। সকাল ছাড়া অন্য কোনও বিভাগের নির্বাচনে তাঁরা মনোনয়ন দাখিল করতেই পারেননি বলে অভিযোগ এসএফআই সদস্যদের। ভিক্টোরিয়া কলেজে জিতেছে এসএফআই। আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কারণে গোলমাল যেখানে সব নজির ছাপিয়ে গিয়েছে, সেই হরিমোহন ঘোষ কলেজেও অধিকাংশ মনোনয়নপত্র তুলে নিয়েছে টিএমসিপি।
টিএমসিপ-ও প্রত্যাশিত ভাবেই তাদের বিরুদ্ধে ওঠা এ সব অভিযোগ মানতে নারাজ। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তমোঘ্ন ঘোষের দাবি, এসএফআই কোথাও প্রার্থী দিতেই পারছে না। তাই তারা মনোনয়নপত্র তুলতে, জমা দিতেও পারছে না। তমোঘ্ন বলেন, “বিদ্যাসাগর সকালে আমরা মাত্র এক আসনে জিতেছি। এসএফআই ১১টি আসন পেয়েছে। টিএমসিপি সন্ত্রাস চালালে কি তা হত?” তৃণমূল ছাত্র পরিষদের উপদেষ্টা মণ্ডলীর চেয়ারম্যান বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “গায়ের জোর দেখানোর অভিযোগ অসত্য। আমরা স্বচ্ছ নির্বাচনের পক্ষে।”
এত দিন ধরে সন্ত্রাস ছড়ানোর যে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উঠেছে, তা অস্বীকার করেছে এসএফআই-ও। সাধারণ সম্পাদক দেবজ্যোতি দাস বলেন, “এ সব অভিযোগের ভিত্তি নেই। গত ৩৪ বছরে ক্যাম্পাসে এমন গুণ্ডারাজ চলেনি।” দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বাম আমলের শেষ দিক পর্যন্তও রাজ্যের প্রায় ৪৫০ কলেজের ছাত্র সংসদের মধ্যে শ’খানেক ছিল বিরোধীদের দখলে। অভিযোগ যদি সত্যি হত, তবে এত ছাত্র সংসদ বিরোধীদের দখলে গিয়েছিল কী ভাবে? এখনকার মতো সন্ত্রাস বাম আমলে কোনও কলেজে হয়নি।”
ছাত্র পরিষদের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কৌস্তুভ বাগচীর ব্যাখ্যা, “সিপিএম-আশ্রিত যে সব গুণ্ডারা আগের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নেতৃত্ব দিত, এখন সেই দুষ্কৃতীরাই তৃণমূলের ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছে। তাই দু’দলের সন্ত্রাসে কোনও বৈশিষ্ট্যগত ফারাক নেই।” |