দীর্ঘ দু’দশক বাদে জেলের বিশাল ফটকটা পেরিয়ে হাসিমুখে মুক্ত পৃথিবীতে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
তাঁর আচরণে খুশি হয়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত খুনের আসামি আলি আহমেদ সর্দারকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। সেটা জানুয়ারি, ২০১০ সালের কথা। তিন বছর পার হতে না-হতেই আলির মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে। নতুন করে জীবন শুরুর চেষ্টায় হাল ছেড়ে জেলেই ফিরতে চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন তিনি।
|
আলি আহমেদ
সর্দার। ছবি: সুব্রত রায় |
কেন? আলির দাবি, “জমি-পুকুর যা ছিল সব বেহাত। মামলা চলছে। আমার বউ আর দিদি বাড়ি বাড়ি কাজ করে। নিজের রোজগারের ঠিক নেই। কখনও দিনমজুরি, কখনও বা রিকশা চালিয়ে উপায় করছি। জেলের জীবনে অল্প হলেও আয়ের নিশ্চয়তা ছিল।”
জেল সূত্রের খবর, ১৯৯১ সালে খুনের অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা হয় আলির। তখন তিনি পঁচিশের যুবক। আলিপুর, দমদম সেন্ট্রাল জেল এবং লালগোলা মুক্ত সংশোধনাগারে ১৯ বছর ছ’মাস জেল খেটেছেন আলি। ভদ্র ব্যবহারে সবার মন জিতে নিয়েছিলেন। কারাবাস থেকে মুক্তির জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আলির আবেদনে তাই সাড়া মেলে ঝটপট। ছন্দপতন তার পরেই। বাস্তবে রত্নাকরের বাল্মীকিতে রূপান্তর আদৌ সহজ নয়। তবু সংশোধনাগারের আড়ালেও নিজেকে শুধরে নিয়ে কেউ কেউ সফল হন সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে। বন্দি-শিল্পীদের উপস্থাপনায় বাল্মিকী-প্রতিভার নৃত্যনাট্যের নায়ক নাইজেল আকারা যেমন বাইরের দুনিয়ায় লড়াই করে শিল্পী হিসেবে নিজেকে একটা জায়গায় দাঁড় করাতে সফল। কিন্তু পথটা আদতে মসৃণ নয়।
প্রায় অর্ধেক জীবন জেলে কাটানোর পরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘুটিয়ারি শরিফের আলি সেটাই টের পাচ্ছেন। অর্জুনা গ্রামের বাড়িতে মধ্য চল্লিশের আলি প্রায় হার স্বীকার করে নিচ্ছেন। বললেন, “জেলে থাকার সময়েই তুতো ভাইরা জমিজমা দখল করে নেয়। থানা-পুলিশ করে কিচ্ছু হল না। এখন ভাবছি, কেন যে মরতে মুক্তির আর্জি জানিয়েছিলাম।” আলির বাড়িতে শয্যশায়ী বৃদ্ধ বাবা, বিধবা দিদি, স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে। এতগুলো পেটে ভাত জোটাতে দিশাহারা জেল-ফেরত গৃহকর্তা। ওই তল্লাটের হারদা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রহুল আমিন নস্কর বলেন, “আলি খুব ভাল ছেলে। জমিজমার সমস্যাটা আসলে ওদের পারিবারিক বিবাদ। আমরা মেটানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু মেটেনি।”
বিস্তর ঝক্কি-ঝামেলার পরে গত ডিসেম্বরে আলি তাই মুখমন্ত্রীকে চিঠিতে লিখেছেন, “এই জ্বালা-যন্ত্রণা, নির্যাতন সহ্য করতে পারছি না।” এক ফোঁটা শান্তির আশায় ফের লালগোলা মুক্ত সংশোধনাগারেই আলি ফেরার আর্জি জানিয়েছেন। জেল থেকে বেরিয়ে কাজ না পেয়ে সঙ্কটে পড়ার অভিযোগ নতুন নয়। “কিন্তু এ ভাবে জেলে ফেরত আসতে চেয়ে আবেদন করার উদাহরণ কিন্তু নেই”— বলছেন রাজ্যের এক কারাকর্তা।
ছাত্রী সুদীপা পালের পরিবারের চার জনকে খুনের মামলার সাজা খেটে ‘মাস্টারমশাই’ রণধীর বসু মুক্তি পেয়েছেন বছরখানেক আগেই। দরদী শিক্ষক হিসেবে সংশোধনাগারে কয়েদি-ছাত্রদের শ্রদ্ধা কুড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাইরে কোচিং ক্লাস খুলে পড়ানোর চেষ্টা তাঁর এখনও সফল হয়নি। রামকৃষ্ণ মিশন ও সংশোধনাগার দফতর রণধীরবাবুকে অর্থসাহায্য করেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোচিং ক্লাস খোলার জন্য কেউ তাঁকে বাড়ি ভাড়া দিতে রাজি হননি।
আলিপুর জেল থেকে যাবজ্জীবন সাজা খেটে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন এসইউসিআই কর্মী বর্ধমানের উত্থান পালও। জেলে এমএ পাশ করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বর্ণপদকও পেয়েছেন। সপ্তাহ দুই আগে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে তিনি চাকরির আর্জি জানিয়েছেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব উত্থানের হতাশা, বয়স বেড়ে যাওয়ায় কেউ চাকরি দিতে চাইছে না। এখন ভরসা সরকার। বাড়িতে অসুস্থ বিধবা মা, অবিবাহিত বোনকে নিয়ে নাজেহাল তিনি। আরও দুই মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দি বাঁকুড়ার রামপ্রসাদ দেওঘড়িয়া এবং মুর্শিদাবাদের মুস্তাকিম শেখও রাজ্য সরকারের কাছে চাকরির আবেদন করেছেন।
কিন্তু তাঁরা কেউই জেলে ফিরতে চাইছেন না। রণধীরবাবু বা উত্থান বলছেন, “যা-ই হোক, জেলে ফিরব না। সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচব।”
তবে এই বাঁচাটা যে সহজ নয়, তা মানছেন অনেকেই। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলছেন, “আমাদের সমাজ সাধারণত বাদ দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী। জেল-ফেরত আলিদের তাই এর সঙ্গেও লড়তে হয়।” সমাজে ফেরার পরেও জেল-কর্তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার কথা জানাচ্ছেন নাইজেল আকারা। কিন্তু তাঁর মতে, নিজের লড়াইটা নিজেকেই লড়তে হবে।
লড়াই কেন? মুক্ত সমাজে থাকতে হলে তার প্রতিযোগিতাও মেনে নিতে হবে, ব্যাখ্যা করেন সংশোধনাগার দফতরের আইজি রণবীর কুমার। তাঁর কথায়, “জেলে কয়েদিরা কাজ পাবেই। কিন্তু বাইরে লড়াই করেই টিকে থাকতে হবে। আমরা বড় জোর কিছু সাহায্য করতে পারি।” আলির ক্ষেত্রেও যেমন আইনি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাতেও কিন্তু আশার আলো দেখছেন না আলি। মাটির দাওয়ায় বসে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, “অনেক কিছু করলাম। কিচ্ছু হল না। এখন জেলই আমাকে ফিরিয়ে নিক।” |