ইকবালের খোঁজে তিন রাজ্য সিআইডি
তাপসবাবুই ছিলেন গুলির লক্ষ্য, দাবি এফআইআরে
গার্ডেনরিচে গত ১২ জানুয়ারি কলকাতা পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ঘটনাস্থলে অন্তত দু’রাউন্ড গুলি চলেছিল। তারই একটি সরাসরি এসে লাগে তাপসবাবুর বুকে। অন্যটি লাগে নিজেকে তৃণমূল কর্মী বলে পরিচয় দেওয়া তাহির হোসেন নামে আর এক জনের হাতে। গার্ডেনরিচ থানায় পুলিশের ‘র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স’-এর ইনস্পেক্টর মিলনকুমার দাম ওই দিন যে এফআইআর দায়ের করেছিলেন, তার ভিত্তিতে এমনটাই মনে করছেন তদন্তকারীরা। পুলিশের দাবি, ওই দিন কলেজ নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা পাহাড়পুর রোডে অন্তত সাত রাউন্ড গুলি চলে।
তাপসবাবুর মৃত্যুর টেলিভিশন ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সূত্রে প্রথম দিকে বলা হচ্ছিল, সে দিন তাহিরকে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল সেখ সুহান। সেই গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তাহিরের হাতে লেগে সরাসরি তাপসবাবুর বুকে লাগে। কিন্তু তদন্তকারীদের দাবি, তা হয়নি। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ছোঁড়া গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে ওই সাব-ইনস্পেক্টরের। মিলনবাবুর এফআইআরের প্রতিলিপি শুক্রবারই হাতে পেয়েছে সিআইডি। ওই এফআইআর-ই আলিপুর আদালতে জমা দিয়েছিল কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশ।
লুটিয়ে পড়েছেন গুলিবিদ্ধ তাপস চৌধুরী। মঙ্গলবার। —ফাইল চিত্র
পুলিশ সূত্রের খবর, সে দিন দু’টি গুলির একটি চালিয়েছিল সেখ সুহান। সেটি সরাসরি তাপসবাবুর বুকে লাগে। অন্য গুলিটি সম্ভবত চালিয়েছিল সুহানের কাকা ইবনে। সেটি লাগে তাহিরের হাতে। ঘটনার দিন থেকে তাহির ভর্তি ছিলেন খিদিরপুর এলাকার একটি হাসপাতালে। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে শনিবার তাঁকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে সিআইডি। তাঁর বিরুদ্ধে হাঙ্গামা বাধানোর অভিযোগ এনেছেন সিআইডি-গোয়েন্দারা।
মিলনবাবু এফআইআর-এ লিখেছিলেন, হরিমোহন ঘোষ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গোলমাল ও সংঘর্ষ বাধে। কলেজের মেন গেটের বাঁ দিকে মোক্তার ও তার দলবল ছিল। ডান দিকে ৬০-৭০ জন যুবককে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতা পুরসভার ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল। কলেজের গেটের ডান দিকে জড়ো হয়ে থাকা যুবকেরা ‘চেয়ারম্যান সাব, চেয়ারম্যান সাব’ বলে চিৎকার করছিল। আর চেয়ারম্যান সাব (ইকবাল) মিলনবাবুর চোখের সামনে আঙুল উঁচিয়ে ওই ছেলেদের প্ররোচনা দিচ্ছিলেন।
আচমকাই ইকবালের দলের চার-পাঁচ জন মোক্তারের দলের এক যুবককে (ওই যুবক তাহির হোসেন অবশ্য আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক। তাঁকে মোক্তারের লোক বলে ভুল করেছিল সুহানরা) হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। কতর্ব্যরত পুলিশ অফিসার তাপসবাবু ওই যুবককে ইকবালের দলের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন। সেটা দেখেই ওই চার-পাঁচ জন যুবকের মধ্যে থাকা সুহান নামে এক যুবক আচমকা আগ্নেয়াস্ত্র বার করে তাপসবাবুকে লক্ষ করে গুলি চালিয়ে দেয়।
সেখ সুহান এবং ইবনেকে পুলিশ সেই রাতেই গ্রেফতার করেছিল। মিলনবাবুর লেখা এফআইআর, কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত এবং তার পরে নিজেদের তদন্তের ভিত্তিতে সিআইডি কিন্তু গোটা ঘটনার পিছনে মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাকেই মূল অভিযুক্ত হিসেবে দেখছে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত ওই তৃণমূল কাউন্সিলর রাজ্য ছেড়ে পালিয়েছেন বলে সন্দেহ সিআইডি-র। তারা বলছে, কলকাতা পুরসভার ১৫ নম্বর বরো-র চেয়ারম্যান হিসেবে যে মোবাইলটি তিনি ব্যবহার করতেন, সেটিও গত তিন দিন ধরে বন্ধ। সিআইডি-র এক কর্তা এ দিন বলেন, “ওই তৃণমূল নেতার খুবই ঘনিষ্ঠ ক’জনের মোবাইলে আড়ি পেতে এটুকু বোঝা গিয়েছে, শুক্রবার রাত পর্যন্ত ইকবাল উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে ছিলেন। সেখানকার সিম ব্যবহার করেছেন। ওই সিম থেকেই নিজের বাড়িতে ও দলের একাধিক লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন।” ইকবালের খোঁজে সিআইডি-র একটি দল এ দিনই অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে।
গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে শনিবার আহত তাহির হোসেন ছাড়াও আরও এক জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। তার নাম আবদুল রুকমন। এ দিন রাতেই ইবনে, সুহানের সঙ্গে রুকমনকেও লালবাজারের সেন্ট্রাল লক-আপ থেকে ভবানী ভবনে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে সিআইডি। ধৃত রুকমন কংগ্রেস নেতা মোক্তারের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। পুলিশের একটি সূত্রের বক্তব্য, ঘটনার প্রথম থেকেই মোক্তার ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক ভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, তত স্পষ্ট হয়েছে, পুলিশ-খুনের সঙ্গে ইকবাল-ঘনিষ্ঠদেরই যোগ রয়েছে। এই ঘটনায় প্রথম দিকে যারা ধরা পড়েছে, তারা সবাই তৃণমূল নেতা ইকবালের ঘনিষ্ঠ। এই প্রথম কংগ্রেস শিবিরের কাউকে গ্রেফতার করা হল। এবং ‘ভারসাম্য’ রাখতে গিয়েই এটা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু তাহিরকে গ্রেফতার করা হল কেন? এক গোয়েন্দাকর্তা বলেন, “হাসপাতালে জেরায় তাহিরের কথায় বেশ কিছু অসঙ্গতি মেলায় তাকে ভবানী ভবনে এনে আরও এক দফা জেরা করা হয়। তার পরেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।” তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র হাঙ্গামা, বেআইনি জমায়েত, কর্তব্যরত পুলিশকর্মীকে কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এনেছে পুলিশ।
গত কাল বর্ধমান থেকে ধৃত অন্য তিন অভিযুক্ত চুড়ি ফিরোজ, মহম্মদ রাজ ও শাকিল নামে তিন দুষ্কৃতীকে এ দিন আলিপুর আদালতে হাজির করা হয়। মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক সুপর্ণা রায় তাদের জামিনের আর্জি খারিজ করে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হাঙ্গামা, বেআইনি জমায়েত, কর্তব্যরত পুলিশকর্মীকে কাজে বাধা দেওয়া ও হত্যার চেষ্টা ছাড়াও অস্ত্র এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে।
সিআইডি-র দাবি, ধৃতেরা জেরায় বলেছে, তৃণমূল কাউন্সিলর ইকবাল ওরফে মুন্নাই তাদের কলেজের সামনে যেতে বলেছিলেন। এমনকী, সংঘর্ষের পরে এলাকা ছাড়ার নির্দেশও এসেছিল তাঁর কাছ থেকেই। সেই মতো ফিরোজরা হাওড়ায় চলে যায়। পুলিশ জেনেছে, শাকিল ও রাজুকে নিয়ে ফিরোজ হাওড়া ময়দানে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে শুক্রবার বিকেলে বালি স্টেশন থেকে তারা বর্ধমানগামী একটি লোকাল ট্রেনে ওঠে। সিআইডি জেনেছে, ফিরোজদের গন্তব্য ছিল উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ। হাওড়া স্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়েই তারা বর্ধমান থেকে ট্রেন ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সিআইডি ওই রাতেই তাদের ধরে। এ দিন দুপুরে আলিপুর বডিগার্ড লাইনসে সব থানার ওসি, এসি এবং ডিসিদের সঙ্গে বৈঠক সেরে গার্ডেনরিচ থানায় যান নতুন পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। ঘটনাস্থলেও যান তিনি। পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিনের বৈঠকের পরে গোটা বন্দর এলাকার গুন্ডাদের তালিকা তৈরি করার নির্দেশ গিয়েছে লালবাজার থেকে। সেই নির্দেশ মেনে শুধু গার্ডেনরিচ থানা এলাকাতেই অন্তত ১০০ জন দুষ্কৃতীর তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ। তাতে যেমন পুরনো মুখ রয়েছে, তেমনই যোগ হয়েছে বহু নতুন মুখও।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.