রাজ্যে সক্রিয় কিডনি পাচার চক্র, তার ইঙ্গিত বারবারই মিলেছে। এ বার দেখা যাচ্ছে, চক্রের বিস্তার এমনই যে তা নিয়ে তদন্তে নামতে হল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইকে। একই সঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডি-ও অন্য একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করেছে রাজ্যের অবৈধ কিডনি প্রতিস্থাপনের কারবার নিয়ে।
মাস দু’য়েক আগে ছত্তীসগঢ় হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল করেন রায়পুরের বাসিন্দা অঙ্কিত শর্মা। তাঁর বক্তব্য ছিল, বাবার কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন দিচ্ছেন না স্থানীয় প্রশাসনিক কমিটি। প্রশাসনের তরফে আদালতে জানানো হয়, ছত্তীসগঢ় স্টেট কাউন্সিলে অনেকগুলি কিডনি প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত আবেদন পড়ে রয়েছে। ছত্তীসগঢ়ের একটি নির্দিষ্ট হাসপাতালেই সবকটি প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত অপারেশন করা হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিডনি দাতা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা এবং কিডনি গ্রহীতা ছত্তীসগঢ়ের বাসিন্দা। এরপরেই আদালত বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার জন্য সিবিআইকে নির্দেশ দেয়।
দিন পাঁচেক আগে সিবিআই তদন্তের কাজ শুরু করেছে। রায়পুরের জেলাশাসক সিদ্ধার্থ কোমল সিংহের থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের তালিকা সংগ্রহ করেছে সিবিআই। একটি বাংলা দৈনিক কাগজে কিডনি বিক্রির বিষয়ে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে বলেও জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। কলকাতার কয়েকটি হাসপাতালেও খবর নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দারা জেনেছেন, ১০ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে কিডনি বিক্রি করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।
এরই মধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সোনারপুর থানার একটি মামলার (কেস নম্বর ১০৫৯/১২) তদন্ত করছে সিআইডি। এ ক্ষেত্রে এক মহিলা অভিযোগ করেছেন, একটি বেসরকারি নার্সিং হোম তাঁর স্বামীর দেহ থেকে কিডনি তুলে নিয়েছে। মৃত স্বামীকে কবর দিতে গিয়ে তিনি তা জানতে পারেন। সরকারি আইনজীবী অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিষয়টি খুবই গুরুতর। চিকিৎসকদের পাঁচ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড রিপোর্ট দিয়েছেন। ডিএনএ টেস্ট করতে পাঠানো হয়েছে।” এই মামলার তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন ডিডিআই (সদর)। তদন্তে এক চিকিৎসক ও একটি নার্সিংহোমের নাম উঠে এসেছে।
এরই মধ্যে কিডনি পাচার সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে সরকারি নানা দফতরে। গত অক্টোবর মাসে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের তরফে জানানো হয়েছিল, কিডনি দাতা বা গ্রহীতাদের বাড়ির ঠিকানার শংসাপত্র না থাকলে কোনও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। শংসাপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে, তিনি স্বেচ্ছায় কিডনি দান করছেন। এরপরে বেশ কয়েকটি কিডনি দানের আবেদন জমা পড়ে মালদহের মহকুমা দফতরে। পরে তদন্তে জানা যায়, সাদা আবেদনপত্রে ‘কিডনিদাতা’দের স্বাক্ষর করানো হয়েছিল। এই তদন্তের কোনও কিনারা হয়নি।
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের বিন্দোল পঞ্চায়েত এলাকায় এর আগেও কিডনি পাচারের ঘটনা নজরে এসেছিল। বিন্দোল পঞ্চায়েতের জালিপাড়া এলাকার অন্তত ১০ জন বাসিন্দা ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কিডনি বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ। মোটা টাকার প্রলোভন দেখিয়ে স্থানীয় পাচারকারীরাই তাঁদের কিডনি বিক্রি করাতে বাধ্য করিয়েছেন বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে পুলিশ।
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে কিডনি পাচার-চক্রের তদন্তে নেমে সিআইডি মনে করছে, বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এবং উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় এই পাচার চক্র সক্রিয়। কলকাতার যে বেসরকারি হাসপাতালগুলি ও চিকিৎসকেরা পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত, তাদেরও নির্দিষ্ট করতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। সিবিআইয়ের এক কর্তার কথায়, “এখন তথ্য সংগ্রহের কাজ চলেছে। বেশ কয়েকটি মোবাইল ও ফোন নম্বরের সূত্র ধরে এগোনো হচ্ছে।”
কিডনি প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ সার্জন কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, “অনাত্মীয়ের থেকে কিডনি গ্রহণকে অধিকাংশ রাজ্যই বেআইনি ঘোষণা করেছে। কেবল কেরল ও পশ্চিমবঙ্গ করেনি। তার ফলেই এই সঙ্কট বারবার দেখা দিচ্ছে। আইন পরিবর্তন না করলে এর সমাধান হবে না। প্রয়োজন হচ্ছে মৃতদেহ থেকে প্রতিস্থাপনকে উৎসাহ দেওয়া।” |