|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
এই যেন শেষ রক্ত হয়... |
গৌতম রায় |
আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস, রাহুল পণ্ডিতা। র্যান্ডম হাউস, ৪৯৯.০০ |
কাশ্মীরে পণ্ডিতরা ১৯৪১ সালের আদমসুমারিতে ছিলেন শ্রীনগর উপত্যকার জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। ১৯৮১-তে সংখ্যাটি নেমে দাঁড়ায় ৫ শতাংশে। তখনও অনন্তনাগে ১৯৮৬-র পণ্ডিত-বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়নি। পণ্ডিতদের পেটানো, তাঁদের মহিলাদের ধর্ষণ করা এবং ঘরবাড়ি ও মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু হয়নি। শুরু হয়নি উপত্যকা জুড়ে ১৯৯০-এর তীব্র, ব্যাপক পণ্ডিত-বিরোধী, ভারত-বিরোধী স্লোগান, মারধর, নির্যাতন। তবু বিদ্বেষের লক্ষণগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরে ভিন্দ্রানওয়ালের সশস্ত্র খলিস্তানি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের ‘জবাবে’ শ্রীনগরের মুসলিমরা আমিরা কাদালের হনুমান মন্দিরে হামলা চালায়। ঝিলম নদীতে হনুমানের বিগ্রহ নিক্ষেপ করা হয়, পুরোহিতরা প্রহৃত হন। ইন্দিরা গাঁধী শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হলে শ্রীনগরের রাস্তায়, বাজারে-হাটে, স্কুলে-কলেজে উত্সব পালিত হয়। তার ঠিক আগের বছরেই ইকবাল পার্কের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার বক্তৃতার সময় একদম সামনের সারির দর্শকরা নিজেদের যৌনাঙ্গ উন্মুক্ত করে বসে থাকে। ১৯৮৩-র ১৩ অক্টোবর শের-ই-কাশ্মীর স্টেডিয়ামে দর্শকরা সারাক্ষণ ভারতীয় ক্রিকেট দলকে হতোদ্যম করতে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে যায় (খেলা হচ্ছিল যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে), বেঙ্গসরকরকে আধ-খাওয়া আপেল ছুঁড়ে মারে, গ্যালারিতে পাক পতাকা ওড়ায়। ’৮৬-র শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনালে চেতন শর্মার শেষ বলে জাভেদ মিয়াঁদাদের ছক্কা হাঁকানোর সঙ্গে-সঙ্গে গোটা শ্রীনগর উপত্যকা উত্সবে মেতে ওঠে। সেই থেকে প্রতি বছর ভারতের স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসে শ্রীনগর ‘নিষ্প্রদীপ’ থাকে। বিশ্বের কোথাও কোনও খেলায় পাকিস্তান ভারতের কাছে হারলেই হিন্দু পণ্ডিতদের জানালার শার্সি খানখান করে আধলা ইট এসে ঘরের ভিতর আছড়ে পড়ে।
এগুলো কোনও বানানো গল্প নয়। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অঙ্গরাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের শ্রীনগর উপত্যকায় একদা বসবাসকারী, তবে অধুনা উদ্বাস্তু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তাঁদের ভিটে-ছাড়া করতে ভয়-দেখানো শুরু হয় ১৯৮৯ থেকে। হুমকি যে অসার নয়, তা প্রমাণ করতে একে-একে হত্যাকাণ্ড শুরু হয় টিক্কালাল টাপ্লু, ভূষণলাল রায়না, মোহন লাল, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নীলকান্ত গঞ্জু...। প্রথমে রাতভর, তারপর দিনভর মিছিল-জমায়েত থেকে
‘নারায়ে তকদির
আল্লা হো আকবর’
ধ্বনি উঠতে থাকে। পণ্ডিত মহল্লায় হামলার সময় নিকটবর্তী মসজিদের মাইকে আজানের ধ্বনি বহু গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে আর্তনাদ বাইরে শোনা না যায়। ‘হাম ক্যা চাহতে: আজাদি’ কিংবা ‘অ্যায় জালিমো, অ্যায় কাফিরোঁ, কাশ্মীর হমারা ছোড় দো’ স্লোগান ১৯৯০-এর মধ্যেই সাড়ে তিন লক্ষ পণ্ডিতকে কাশ্মীর উপত্যকার ভদ্রাসন ছেড়ে শরণার্থী হতে বাধ্য করে। দিল্লি থেকে জগমোহনকে রাজ্যপাল করে পাঠানো হয়। কিন্তু তত দিনে শুরু হয়ে গেছে দু’হাজার বছরেরও বেশি কালের স্বদেশ থেকে পণ্ডিতদের নির্বাসন। তারপর তা চলতেই থাকে। ১৯৯৭-এর মার্চ মাসে সংগ্রামপুরা গ্রামে ৭ জন পণ্ডিতকে বাড়ি থেকে বার করে হত্যা করা হল। ’৯৮-এর জানুয়ারিতে ওয়ান্ধামা গ্রামে শিশু ও নারী সহ ২৩ জন কাশ্মীরি পণ্ডিতকে বিনা প্ররোচনায় ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়। ২০০৩-এর মার্চে নদীমার্গ গ্রামে আবার ২৪ জন পণ্ডিতের নৃশংস গণহত্যা।
কাশ্মীর উপত্যকা এ ভাবেই পণ্ডিতমুক্ত হতে থাকে। পণ্ডিত পরিবারগুলি উদ্বাস্তু হয়ে জম্মুর শিবিরে তাঁবুতে আশ্রয় নেয়। জম্মুর তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করতে-করতে ওই তাঁবুতে কিংবা এক কামরার অপরিচ্ছন্ন বস্তিতে কোনও মতে সংসার, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, বয়স্কদের চিকিত্সা ও সকলের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা, সরকারের কাছ থেকে রেশনে চাল-গমের ডোল নিয়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি। যাঁদের উঠোনে ফলবতী আপেলের বাগান ছিল, ঘরে ছিল দেওদার কাঠের বহুমূল্য আসবাব, জম্মুতে তাঁদেরই চরম অসম্মানের গ্লানি নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। সমধর্মী হিন্দুরাও শরণার্থীদের ‘উটকো আপদ’ বলেই গণ্য করে, তাদের মেয়েদের মনে করে সহজলভ্য, সস্তা পণ্য। দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে এবং উপত্যকায় তাদের ফেরার সম্ভাবনা কমে আসায় উত্ফুল্ল মুসলিমরা শ্রীনগরের অভিজাত এলাকায় তাদের বসতবাড়ি, বাগান জলের দরে কিনে নিতে জম্মুতে দালাল পাঠাতে থাকে। যে মধ্যবয়স্ক দালালরা জম্মুতে টোপ নিয়ে হাজির হয়, দেখা যায়, তাদের ছেলেরাই উপত্যকায় হিজবুল মুজাহিদিনের এরিয়া-কমান্ডার। কাশ্মীরিদের তথাকথিত স্বাধীনতা-সংগ্রাম কি তা হলে ভূস্বর্গ থেকে আদি বাসিন্দাদের বিতাড়িত করে বহিরাগতদের দখল নেওয়ার অভিযান?
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের স্বদেশ হারানোরই উপাখ্যান— আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস। আমাদের সকলের চোখের সামনে গত দু-তিন দশক ধরে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু আমরা (যারা অবশিষ্ট ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের ও রাষ্ট্রের বঞ্চনা ও নিপীড়ন নিয়ে এত মুখর, তারাই, কী আশ্চর্য) কাশ্মীর উপত্যকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু পণ্ডিত পরিবারগুলির উপর সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের চালানো হত্যা-ধর্ষণ-ধর্মান্তর অভিযান বিষয়ে অদ্ভুত মৌনী। যেন আমরা দেখতেই পাচ্ছি না যে, ঘটনাটা ঘটে চলেছে। আর আমরা, অর্থাত্ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানুষরা যেটা দেখতে পাচ্ছি না, সেটা তো নিশ্চয় ঘটছেও না। বরং কট্টরপন্থী হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি যখন নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে উদ্বাস্তু-করে-দেওয়া পণ্ডিতদের উপত্যকায় ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, তখন দিব্যি তাঁর সেই আশ্বাসে ভরসা রাখছি, তাকে প্রতারণামূলক মনে করছি না। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের শিখিয়েছে সংখ্যালঘুর ধর্মান্ধতা ও জেহাদি মতাদর্শের মধ্যেও সমন্বয় ও সংশ্লেষের সুর খুঁজে পেতে। তাই পণ্ডিত পরিবারগুলি যখন বিএসএফ-এর ক্যাম্প না-থাকলে দিনের বেলাতেও ঘরের বাইরে বেরতে চাইছেন না, আমরা তখন ‘কেন ওই ক্যাম্প এখনও তুলে নেওয়া হচ্ছে না’, তাই নিয়ে জনস্বার্থ মামলা করছি, পণ্ডিত-তাড়ানো জেহাদিদের মানবাধিকার রক্ষায় মড়াকান্নাও কেঁদে মরছি। রাহুল পণ্ডিতা নিজে সপরিবার উপত্যকা থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। তাঁর ভাই-দাদা, নিকটাত্মীয়েরা নিহত, ধর্ষিত হয়েছেন, পূর্বপুরুষরা ধর্মান্তরিতও। প্রথম কৈশোরে জম্মুর উদ্বাস্তু শিবির, পরে দিল্লিতে এখন তিনি সাংবাদিকের পেশায় কৃতবিদ্য। উপত্যকায় নিজের ফেলে-আসা ভিটে দেখতে গেলেও তিনি জানেন, ওখানে কখনওই আর ফেরা হবে না। পণ্ডিত পরিবারগুলির বর্তমান প্রজন্মের কাছে কাশ্মীর দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে-বাঁধানো সিপিয়া রঙের ছবির মতো, মৃত পূর্বপুরুষদের শুকনো মালা-পরা ছবির পাশেই যা সাজানো থাকে। কিন্তু উপত্যকার সেই আনন্দবেদনাময় স্মৃতি, সেই মিলন ও বিচ্ছেদের, বিভাজন ও বিদ্বেষের, নির্যাতন ও বঞ্চনার আখ্যান তো ভুলে গেলে চলবে না। বরং সেই ব্যক্তিগত স্মৃতি নিয়েই রাষ্ট্রীয় ও যূথবদ্ধ বিস্মরণের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালাতে হবে। রাহুলের এই স্মরণগ্রন্থ সেই রক্তচিহ্নলাঞ্ছিত চান্দ্র উপত্যকার ম্লান-হতে-থাকা জ্যোত্স্নালোকিত অবয়ব। এ বই না পড়লে আজকের কাশ্মীর অজানা থেকে যাবে, বোঝা যাবে না সেই অমর পঙক্তিমালার সম্যক তাত্পর্যও— যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াব, আমি বিষ পান করে মরে যাব...। |
|
|
|
|
|