ব্যাগ গুছিয়ে...

চাঁদ-পাহাড়ের ঠিকানায়
সারাটা রাত হুটোপুটি খেল চাঁদ।
আছড়ে পড়ল তাঁবুর চালে। লুটিয়ে থাকল আদিগন্ত রডোডেনড্রন অরণ্যে, কত বার যে ঘোড়েল মাতালের মতো লুটিয়ে পড়ল লোপচু চা বাগানের ঘন ঢালে। তার পরে ভোর রাতে, এক মুঠো কুয়াশার আড়ালে সে যখন ফ্যালফ্যাল করে অসহায়, গলে যাচ্ছে, তখনই ডেকে উঠলো পেমবা শিরিঙের মোরগ। আড়মোড়া ভাঙছে লামহাট্টা।
তাকদা বাজার থেকে মস-ফার্নের পাহাড়টাকে বাঁ দিকে রেখে ৬ মাইল ধরে যে রাস্তাটা কিঞ্চিৎ লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে তিস্তা বাজারের দিকে গড়িয়ে গিয়েছে, শীতে জবুথবু ঘুঘুর মতো সে পথেই থম মেরে আছে লামহাট্টা।
দার্জিলিং থেকে মেরেকেটে ২৩ কিলোমিটার। ছিট্কে রাস্তা পেরোয় শেষ বিকেলের বনমোরগ, তার পরে ঝাঁক বাঁধা ব্যবলার পাখি।
আমরা কি নীচে নামছি? তাকদার রেঞ্জ অফিসার সুরেশ পাণ্ডে বললেন, “শুধু উঠলে হবে, একটু নামুন না স্যার। দেখবেন ঠান্ড ক্যায়া চিজ হ্যায়।”
আমরা নামলাম, এবং ১৭০০ মিটার উচ্চতায় ছুরিতে শান দেওয়া শীতেল হাওয়ায় কুঁচকে-দুমড়ে দু’তালুতে ফুঁ দিয়ে স্পষ্ট ফালাফালা হয়ে দেখলাম, ছোট্ট জনপদটা চুপ করে দেখছে আমাদের শীতকাতুরে শহুরে অসহায়তা।
রাস্তার পাশে সাকুল্যে গোটা কুড়ি বাড়ি। খান তিনেক ছিমছাম চায়ের দোকান। একটা মুদিখানা। চিনি থেকে নুডল্স নিয়ে সন্ধে অবধি সেখানে বলিরেখা দীর্ণ এক বৃদ্ধ। আর মোমো-চাউমিন-কফির এক কাঠের ঝুলন্ত দোকান। ব্যস। আটপৌরে লামাহাট্টার এখানেই ইতি।
বাকিটা অনন্ত পাহাড়ের কোলে একে ওকে ছাপিয়ে সুউচ্চ পাইন। সবুজ মস মাড়িয়ে পাহাড়চূড়ায় চুপ করে থাকা দু’টি নিঃসঙ্গ হ্রদ। শাল, শিশু, বাঁশ, আদা, এলাচ আর দারচিনির ইতিউতি ঝোপ। অসীম জঙ্গলে মেঘ-সূর্যের নিরন্তর লুকোচুরি। বন চিরে আচমকা ডেকে ওঠা কোটরা কিংবা ক্রো-ফেজেন্টের ঘাই। আর, পাহাড় থেকে পাহাড়ের কোলে ধাক্কা খেয়ে হারিয়ে যাওয়া হিমালয়ের হাওয়া। সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে ঘন হলুদ চা-ফুল নিয়ে লাজুক লাজুক রংলি রংলিয়াত ‘দাস ফার অ্যান্ড নো ফারদার’। মানে?
লোক-কথাটা এই রকম: ভাল চায়ের খোঁজে পাহাড়ের ধোঁয়া ওঠা কুয়াশা পথে ঘুরে ঘুরে বহু বাগানের চা-চেখেও মন ছোঁয়নি পাঁচ প্রাজ্ঞ লামার। লোপচুর কোলে এই বাগানের চায়ে চুমুকু দিয়েই তাঁদের ক্লান্ত মন একেবারে সাফসুতরো হয়ে উঠেছিল। স্বগতোক্তির মতো তাঁরা সমস্বরে বলে উঠেছিলেন, ‘রংলি রংলিয়াত।’
একটা মরা শালের লক্ষ্মণরেখায় তাকদা চা-বাগান যেখানে শেষ, রংলি রংলিয়াত জেগে উঠেছে সেখানেই। দু’বাগানের মাঝে নির্মেদ এক চাতাল। চারপাশে অজস্র সিট্রোনেলার ঝোপ। তিস্তা থেকে উড়ে আসা হুহু হাওয়া। আর বাগানের উপরে এক চিলতে ছায়া ফেলে উড়ে যায় এক ঝাঁক ধনেশ পাখি। বছর দশেক আগেও চৌকো কাঠের পাংশু বাক্সে এ বাগানের দুর্ধর্ষ চা মিলত কলকাতার পরিচিত দোকানে। সঙ্কোচে ছিঁড়ে নিই একটা পাতা। ঝুপ করে পড়ে আসে আলো। ব্যস, আর নয়। পাহাড়ি চাঁদ-পথ মাড়িয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসি। সুরেশ জানান, কাল রাতেও লেপার্ড হেঁটে গিয়েছে এ পথে।
তাঁবুর খোলা চাতাল। নিভন্ত বিকেলের ছায়ায় উপুড় হয়ে আছে পাইনের ছায়া। আমাদের ঠিকানা। ‘গ্লাস লাগা দুঁ সাব’, পেমবা ছুটে যায় অনেক নীচে তাঁর কাষ্ঠ কুঠিতে। জিপার টেনে তাঁবুতে প্রবেশ। ভিতরে আড়াআড়ি দু’টো খাটে তিন স্তর কম্বল। সব শেষে দুধ সাদা লেপ। এক কোণে গনগনে রুম হিটার। ছড়িয়ে আছে ঘুমন্ত মোবাইল। শীতের অরণ্যে কে কার ডাকে সাড়া দেয়! কাচের গ্লাস এ ওর গায়ে ঠোক্কর খায়। রিনরিন করে সেই কাচের সংঘাত গড়িয়ে যেতে থাকে বন-পাহাড় উজিয়ে কবেকার তিস্তায়। তার পরে সারা রাত চাঁদ...
তাঁবু-ঠিকানা ছাড়াও খান পনেরো হোম-স্টে। আটপৌরে বাড়ির বারান্দায় শীতের মরসুমি ফুল। উঠোনে মোরগ। সকালের চা থেকে দুপুর বা রাতের ভাত-রুটি-চাউমিন। সন্ধেয় পকোড়া। সব নিয়ে প্যাকেজ, জন প্রতি দেড় থেকে দু’হাজার। লামহাট্টার সব বাড়ি গোলাপি। পাহাড়ি জয়পুর যেন। তবে তাঁবুর পর্দা সরালেই ভাই-বোন সমেত কাঞ্চনজঙ্ঘা সেখানে কোথায়?
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পিচ রাস্তায় কখনও বা ছুটে যাওয়া গাড়ি। দার্জিলিং ২৩, কালিম্পং ৪১, অনেক নীচে সমতলে শিলিগুড়ি ৭৬ কিলোমিটার। সবুজ বোর্ডে সাদা তিরচিহ্ণ রাতভর জ্বলজ্বল করে। রাস্তার ওপারে সদ্য পার্ক গড়েছে বন দফতর। রং বেরঙের পতাকা। দোলনা, ঢেঁকি, ছানাপোনাদের হরেক মজারু। নীচের জঙ্গল চিল-চোখে দেখতে ওয়াচ টাওয়ার। খান পাঁচেক সবুজ বেঞ্চ, মুখোমুখি বসিবার কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর, এই সব পিছনে ফেলে নিশ্চুপে উঠে যাওয়া এক পাকদণ্ডী।
শহরের জখম ফুসফুস নিয়ে মেঘ ছোঁয়া পাইন-ধুপির বন পেরিয়ে সেখানে এক বার পৌঁছে গেলে টলটলে পাহাড়ি চোখের মতো দু’টি ছিমছাম হ্রদ।
মাস কয়েক আগে তাকদা ফেরত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আচমকা গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েছিলেন। ঝপাঝপ আইপ্যাডে ছবি তুলে তাঁর স্বগোতক্তি ছিল, ‘ও মা!’ তাঁর মুগ্ধতাজনিত বিস্ময়ের ঠেলায় এগিয়ে এসেছিল বন উন্নয়ন নিগম। লামহাট্টার বন সংরক্ষণ কমিটির ব্যবস্থাপনায় গত দেড় বছরে পাহাড়ের কোলে ঘুমন্ত গ্রামটাকে সাজিয়ে দিয়েছে বন দফতর।
বুভুক্ষু পর্যটক, দাপুটে গাইড, প্যাকেজ ট্যুরের ওয়ান নাইট-টু ডেজ-এর বিড়ম্বনা থেকে বহু দূরে, হারানো এই জনপদে এখনও তাই ধনেশের ডানায় নামে সন্ধে। নিঃসঙ্কোচে নেমে আসে হলুদ চাঁদ। আর, শেষ রাতে ডেকে ওঠে পেমবার মোরগ...‘তুমি আ-স-ছো- তো...।’

কী ভাবে যাবেন
হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। কিংবা প্লেনে বাগডোগরা।
সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে লামাহাট্টা ৭২ কিলোমিটার।
দাজির্লিং থেকে গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যায়।
কখন যাবেন
বর্ষার সময়টুকু ছাড়া সারা বছরই যাওয়া যায়। তবে শীতকালে পাহাড়ে অন্য স্বাদ।
কোথায় থাকবেন

এগারোটি হোম-স্টে, অর্থাৎ কাঠের ছিমছাম বাড়ি রয়েছে। তবে তাঁবুতে রাত্রি যাপনের মজাই আলাদা।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.