হাওড়া স্টেশন
মুখোশের আড়ালে
দেশের প্রথম সারির রেল স্টেশন কি ক্রমেই তার কৌলীন্য হারাচ্ছে?
এই প্রশ্ন উঠছে হাওড়া স্টেশনকে নিয়ে। ১৯৯৫-এর পরে এই স্টেশনকে ঝাঁ-চকচকে করে ঢেলে সাজার কাজ শুরু হয়। প্ল্যাটফর্মে বোর্ডে লেখা হয় ‘ক্লিনলিনেস ইজ গডলিনেস’। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সে পরিচ্ছন্নতা আজ উধাও। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে যাওয়া মানেই সব মিলিয়ে ধুলো, আবর্জনা আর দুর্গন্ধময় পরিবেশে প্রবেশ করা।
হাওড়া স্টেশনের বাইরে এলেই দেখা যায় গঙ্গার দিকে সার দিয়ে মাছ-ভাতের ঝুপড়ি হোটেল। রাস্তার পাশেই উপচে পড়া ভ্যাট। নাকে আসে কিছু দূরের পাইকারি মাছ ও সব্জিবাজারের দুর্গন্ধ।
অভিযোগ উঠেছে, দূষণের দায়ে যে স্টেশন ১৯৯৫-এ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বন্ধ হতে চলেছিল, সেই স্টেশনের অধিকাংশ প্ল্যাটফর্ম কার্যত গণশৌচাগারে পরিণত হয়েছে। যাত্রীদের একাংশ অবাধে প্ল্যাটফর্মের ধারে ও রেললাইনে মল-মূত্র ত্যাগ করছেন। রেলের শৌচাগারের নোংরা জলে মাঝেমধ্যেই সাবওয়ে ভেসে যায়। যাত্রীদের এই জল পেরিয়েই যাতায়াত করতে হয়।
অভিযোগ, সব থেকে খারাপ অবস্থা লোকাল ট্রেনের টিকিট বুকিং অফিসের। সেখানকার কর্মীদের অভিযোগ, বুকিং কাউন্টারের পিছনেই রয়েছে রেলের নিকাশি নালা। সম্প্রতি বুকিং অফিসের দেওয়াল ফেটে সেই দুর্গন্ধময় জল অফিসে ঢুকছে। তার মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে কর্মীদের। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ, মেটাল ডিটেক্টর, লাগেজ স্ক্যানার ও রেলরক্ষী বাহিনীর নজরদারি থাকলেও ভবঘুরে ও ভিখারির দল অবাধে স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়। দিনের ব্যস্ত সময়ে গেলেই ১ থেকে ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নোংরা পুঁটলি নিয়ে ভবঘুরেদের শুয়ে-বসে থাকতে দেখা যায়। কেউ কেউ সেখানে কার্যত সংসার পেতেছেন।
হাওড়া স্টেশনে পুরনো ও নতুন কমপ্লেক্স মিলিয়ে ২৩টি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। প্রতি দিন অজস্র যাত্রী এখান দিয়ে যাতায়াত করেন। স্টেশনে পাহারা দেন রেলরক্ষী বাহিনী ও রেলপুলিশের কয়েকশো কর্মী। কিন্তু অভিযোগ, তা সত্ত্বেও প্ল্যাটফর্ম ও রেললাইনে যাত্রীদের একাংশ অবাধে প্রস্রাব করেন। যত্রতত্র পিক ফেলেন। নিয়মিত পরিষ্কারের অভাবে লাইনের মাঝের নিকাশি নালা ভরে থাকে পাঁকজল, প্লাস্টিকের কাপ ও অন্যান্য আবর্জনায়। অভিযোগ, ‘ক্যাবওয়ে’র (স্টেশনের মাঝ দিয়ে বেরোবার রাস্তা) দু’পাশের প্ল্যাটফর্মও অপরিষ্কার এবং দুর্গন্ধময়। সেখানেও অবাধে প্রস্রাব করছেন ভবঘুরে ও যাত্রীদের একাংশ।
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের কথায়: “হাওড়া স্টেশনের ক্যাবওয়ের পাশে দাঁড়ানো ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসেও দুর্গন্ধ তাড়া করে বেড়ায়। মুম্বই বা দিল্লির স্টেশনে গেলে হাওড়ার কথা ভেবে লজ্জা হয়।” একই অভিজ্ঞতা কসবার ব্যবসায়ী সুগত সেনের। ব্যবসার কাজে তাঁকে প্রায়ই দিল্লি-মুম্বই করতে হয়। তাঁর বক্তব্য: “হাওড়া স্টেশনের বাইরের ও ভিতরের পরিবেশ এত খারাপ হয়ে গিয়েছে যে এখানে এসে ট্রেন ধরার কথা ভাবলে কষ্ট হয়। এত ধুলো, অপরিচ্ছন্নতা থাকে কী করে?”
প্রায় একই অবস্থা স্টেশনের দক্ষিণ দিকে পার্সেল বিভাগেরও। সংস্কার না করায় শৌচাগারের বর্জ্য এসে পড়েছে রাস্তায়। তার মধ্যেই পড়ে থাকে খাবারের প্যাকিং বাক্স। স্টেশনের এক কর্মী বললেন, “স্টেশনের বহু সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার না করায় বিভিন্ন জায়গায় বর্জ্য পাইপ ফেটে রাস্তায় পড়ছে। বার বার জানালেও হুঁশ নেই কর্তৃপক্ষের।”
অভিযোগ উঠেছে স্টেশনের অগ্নিনিরাপত্তা নিয়েও। স্টেশনের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুতের কেব্ল বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে আছে। গত বছর যাত্রী নিবাসের পিছন দিকে ঝুলে থাকা খোলা তারে আগুন লেগে যায়। তার পরেও কিন্তু হুঁশ ফেরেনি রেল কর্তৃপক্ষের। আজও অরক্ষিত ভাবে কেব্লগুলিকে রেখে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
কেন এই হাল?
হাওড়ার ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার অনির্বাণ দত্তের দাবি, এই হাল হয়েছে এক শ্রেণির যাত্রীর সচেতনতার অভাবে। তিনি বলেন, “স্টেশন চত্বর সব সময়েই পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করা হয়। এ জন্য বেসরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে। কিছু জবরদখলকারী, হকার এবং ভবঘুরেও স্টেশন অপরিচ্ছন্ন করেন। পুলিশ দিয়ে সরাতে গেলে উল্টে রেলের নামেই ‘অমানবিক’ আচরণের অভিযোগ ওঠে। তাই কিছু উপায় থাকে না।”
স্টেশনের বাইরের হালই বা এ রকম কেন?
হাওড়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত কেএমডিএ-র এক ইঞ্জিনিয়ার বলেন, “স্টেশন থেকে বেরোবার পরে যে দু’টি ভ্যাট পড়ে তা আমাদের জায়গায়। কিন্তু আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব থাকে হাওড়া পুরসভার উপর। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই।” ভ্যাট দু’টি কি ওই জায়গা থেকে সরানো যায় না? তিনি বলেন, “আমরা জায়গা পাচ্ছি না। পেলেই সরিয়ে দেওয়া হবে।” পাশাপাশি, হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল অপসারণ) দেবাশিস ঘোষ বলেন, “আমরা নিয়মিত ওই জায়গার জঞ্জাল পরিষ্কার করি। জায়গা পেলে ওই দু’টি ভ্যাট আমরাও সরিয়ে নেব।”

ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.