মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেদের দাম কত? অন্তত মাসে এক কোটি আটাশ লক্ষ টাকা। ইহা অবশ্য একটি বিশেষ জেদের মূল্য বাজারের সহিত তাল রাখিয়া বাসভাড়া না বাড়াইবার জেদ। যথেষ্ট ভাড়া না বাড়ায় জে এন এন ইউ আর এম প্রকল্পের টাকায় কেনা বাসের ঋণের কিস্তি দেওয়া অসম্ভব হইয়াছে। সরকারি পরিবহণ সংস্থাও ঋণ শুধিতে পারিতেছে না, বেসরকারি মালিকরাও নহেন। এই দিকে, রাজ্য সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাসমালিক কিস্তির টাকা দিতে ব্যর্থ হইলে সরকার রাজকোষ হইতে সেই টাকার ব্যবস্থা করিবে। সেই খেসারতের পরিমাণই মাসে এক কোটি আটাশ লক্ষ টাকা। যে শূন্য রাজকোষ অর্থমন্ত্রীর রাতের ঘুম উড়াইয়া দিয়াছে, সেই রাজকোষের উপর এই চাপ সৃষ্টি করিবার জেদটি মুখ্যমন্ত্রী কোন যুক্তিতে ন্যায্য বলিয়া প্রতিষ্ঠা করেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাহা জানিতে উদ্গ্রীব। ইহা এক প্রকার ভর্তুকি। অস্বচ্ছ ভর্তুকি। মুখ্যমন্ত্রী যদি সটান বলিয়া দিতেন যে বাসভাড়া বাড়াইবার বদলে তিনি বাসমালিকদের মাসে মাসে সরাসরি ১৬,০০০ টাকা ভর্তুকি দিবেন, তাহা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হইত। অন্তত, তাহাতে তাঁহার সরকারের নীতির একটি দিশা পাওয়া যাইত। সেই প্রশ্নে বিতর্ক সম্ভব ছিল সরকারের অবস্থানের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি পেশ করিবার অবকাশ ছিল। কিন্তু প্রকাশ্য ভর্তুকির পরিবর্তে চোরাপথে ভর্তুকির ব্যবস্থা করিবার মধ্যে, অনুমান করা চলে, বিতর্ক এড়াইয়া যাওয়ার চেষ্টা আছে। সম্ভবত এই ভর্তুকির পক্ষে খাড়া করিবার মতো কোনও কুযুক্তিও মুখ্যমন্ত্রীর নিকট নাই।
অর্থনীতির যুক্তিকে গায়ের জোরে অগ্রাহ্য করিবার অসুখটি রাজনীতিকমাত্রেই কম-বেশি থাকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসুখটির তীব্রতা ভীতিজনক। তিনি এখনও বুঝেন নাই আশঙ্কা হয়, ভবিষ্যতেও বুঝিবেন না যে, জনমনোরঞ্জন হাওয়ায় হয় না। যে রাজনীতি অর্থনীতিকে অস্বীকার করে, তাহার মুখ থুবড়াইয়া পড়াই ভবিতব্য। মুশকিল হইল, মমতাদেবী পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী জল-মাটিতে আজন্ম লালিত। ফলে, তাঁহার চিন্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অর্থনীতির যুক্তিকে অস্বীকার করিবার প্রবণতা দৌড়াইতেছে। তিনি দুনিয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাস পড়িয়া দেখিতে পারেন পশ্চিমবঙ্গ হইতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভেনেজুয়েলা হইতে মাও-এর আমলের চিন, বাজারকে অস্বীকার করিয়া বামপন্থী অর্থনীতি কোথাও জয়ী হইতে পারে নাই। এখন প্রশ্ন, তিনি ইতিহাস হইতে শিখিবেন, না কি মৃত পশ্চিমবঙ্গের উপর খাঁড়ার ঘা দিয়াই তাঁহার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ভরিয়া উঠিবে? যে মা-মাটি-মানুষের দোহাই দিয়া তিনি বাসভাড়া না বাড়াইবার জেদে অটল থাকিলেন, মাসে এক কোটি আটাশ লক্ষ টাকা কি সেই মা-মাটি-মানুষকেই দিতে হইতেছে না? যে রাজ্যের রাজকোষ সম্পূর্ণ শূন্য, সেই রাজ্যে এই টাকায় কতখানি উন্নয়ন সম্ভব হইত, মুখ্যমন্ত্রী ভাবিয়া দেখিয়াছেন কি? অবশ্য, পরিবহণে চোরা ভর্তুকি না দিতে হইলে সেই টাকায় ইমামদের আরও ভাতা দেওয়া হইত, এমন আশঙ্কা উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ, মানুষকে শুধু মুখেই রাখিবেন না, মনেও স্থান দিন। |