চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
প্রকৃতির আলোও আজ ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে
ন্দ্রপ্রমিত রায় অনেক দিন থেকেই তাঁর ছবিতে তুলে আনছেন বিমূর্তায়িত নিসর্গের যে আবহ, তাকে বলা যেতে পারে প্রত্যন্তের পরিসর। দৃশ্যমান বাস্তবের সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্ষীণ। তা অনেকটাই সচেতন মনের অগোচর। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সাবলিমিনাল’। গ্যালারি ৮৮তে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল ২৪টি জলরঙের ছবি নিয়ে তাঁর যে একক প্রদর্শনী তার শিরোনামও দেওয়া হয়েছে ‘লিমিনাল জোন’।
নিসর্গের এই ‘প্রত্যন্ত-পরিসর’ আজকের সময়েরই অনিবার্য প্রতিফলন। উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রযুক্তির বিপুল বিস্তার, বৃহত্‌ শক্তি ও ক্ষমতার আগ্রাসী আস্ফালন, উপভোগের দুর্দমনীয় বিস্ফারের পাশাপাশি দারিদ্র ও হিংসার আবিশ্ব প্রসার এ সমস্তই এই সময়কে এবং এই সময়ের অন্তর্গত পরিসরকে আমাদের চেনার সীমার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। নিসর্গের যে মরমি আধ্যাত্মিকতা-অন্বিত আবহ আমরা দেখে এসেছি আমাদের আধুনিক ও আধুনিকতাবাদী চিত্রধারায় তার মধ্যেও আপাত-দৃশ্যতার অন্তরালবর্তী আলো-আঁধারের নানা সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা ছিল। ‘লিমিনালিটি’-র সদর্থক প্রকাশের অভাব ছিল না। রবীন্দ্রনাথের নিসর্গে খুব বেশি করে ছিল। মগ্নচেতনার আঁধারের সঙ্গে সেখানে প্রতিফলিত হচ্ছিল ঔপনিষদিক আলো। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় তমসা-অতিক্রান্ত এক আলোর সন্ধান করেছেন। রামকিঙ্কর সমাজ-সংঘাতের ভিতর দিয়েই প্রত্যন্তের এক বিরল সৌন্দর্যকে আভাসিত করতে চেয়েছেন। ১৯৬০-এর দশকে এসে গণেশ হালুই-এর মতো শিল্পী বাংলার নিসর্গের দৃশ্যতাকে দ্রবীভূত করে যে বিমূর্তের পরিসর এনেছেন লিমিনালিটির কিছু বৈশিষ্ট্য সেখানেও ছিল।
শিল্পী: ইন্দ্রপ্রমিত রায়
আমরা যখন বিশ্বায়ন ও উত্তর-আধুনিকতা অধ্যুষিত ১৯৯০-এর দশক পরবর্তী সময়ে আসি, তখন এই ‘প্রত্যন্তে’র চরিত্র আমূল পাল্টে যায়। চিত্রভানু মজুমদারের ছবিতে এক সংক্ষুব্ধ অন্ধকারের যন্ত্রণা দেখতে পাই। ইন্দ্রপ্রমিত ততটা আঁধারলিপ্ত নন। প্রত্যন্তের ভিতর তিনি আলোও দেখতে পান। কিন্তু সে আলো এক শূন্যতাকে ধারণ করে রাখে। প্রকৃতির আলোকিত স্পন্দন এবং তার অন্তর্লীন পরিব্যাপ্ত শূন্যতার দ্বান্দ্বিকতা থেকে জেগে উঠেছে তাঁর ছবি।
ইন্দ্রপ্রমিত বিশ্বভারতীর আবহমণ্ডলে চিত্রকলার স্নাতক শিক্ষা নিয়েছেন। স্নাতকোত্তর করেছেন বরোদা থেকে। তার পর লন্ডনের রয়াল কলেজ অব আর্ট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আলোচ্য প্রদর্শনীর ছবিগুলিতে আমরা এই সমন্বিত চেতনার বিশেষ এক দার্শনিক প্রস্থানের অবস্থান দেখতে পাই। ভেঙে পড়া সভ্যতার অন্তরালবর্তী প্রত্যন্তের এক বিপন্ন আলোকে তিনি গড়ে তুলতে চাইছেন। বিলীয়মানতার মধ্যেও তিনি অসীমের আলোকরেখা জাগাতে চাইছেন। আর একটি ব্যাপার, জলরঙের ব্যবহারেও তাঁর স্বকীয়তার পরিচয় মেলে।।
আজকের সভ্যতা প্রকৃতিকে গ্রাস করছে। শহর ছেয়ে যাচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গলে। তার কোনও নিজস্ব চরিত্র নেই। মানুষের তৈরি রিক্ততায় প্রকৃতির আলোও শূন্যতায় পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। ‘গ্রে ডন’ ছবিতে তিনি সে রকমই এক ধূসর প্রভাতের আলেখ্য আঁকেন। অনেক উপর থেকে দেখা যাচ্ছে বহু দূর বিস্তৃত এক শহর। পুঞ্জ পুঞ্জ অট্টালিকা দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়ানো। উপরে নীল আকাশ। অসীম শূন্যতা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে সমগ্র পরিমণ্ডলে। ‘ডন ব্রেকিং’ ছবিতে সকাল হওয়ার দৃশ্য। এখানেও আকাশের উচ্চতা থেকে দেখা হচ্ছে ছড়িয়ে থাকা শহরের বাড়ি-ঘর। ‘ফ্যাক্টরি’ বা ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেপ’ ছবিতে প্রযুক্তিশিল্পের নির্মাণের নানাবিধ আভাস এনেছেন খুবই সংবৃত উপস্থাপনায়। ‘ডেজার্ট মর্নিং’ ছবিতে মরুভূমির শূন্যতা সরাসরি উপস্থাপিত হয়েছে।
কিন্তু শূন্যতাতেই অবসিত হচ্ছে না সব কিছু। অন্ধকারের ভিতর থেকে আলোও উদ্ভাসিত হচ্ছে। ‘ফেয়ারি লাইটস ১’ শীর্ষক ছবিটি একটি দৃষ্টান্ত। গভীর নীল রাত্রির অন্ধকার আকাশ। তার ভিতর ছড়িয়ে আছে পুঞ্জ পুঞ্জ বৃত্তাকার আলো। প্রকৃতির অব্যক্ত রহস্যময়তার স্মারক। ‘নকটার্ন’ বা ‘ফায়ার ওয়ার্কস’ শীর্ষক ছবিগুলিতেও দেখা যায় রাত্রির বুকে আতসবাজির আলোকময়তা। অন্ধকার থেকেই যেন উত্‌সারিত হচ্ছে আলোর প্রার্থনা। সমাহিত ধ্যানমগ্নতা আছে শুধু। এই মগ্নতাই ‘সান্ধ্যরাগ’ শীর্ষক ছবিটিতে বিমূর্ত সুরের অনুরণন আনে। এই হল প্রত্যন্তের পরিসর। ‘লিমিনাল জোন’।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.