|
|
|
|
রায়নায় ধৃত মুন্নার ডান হাত |
ইকবালের খোঁজে বোরখার আড়ালে অভিযান |
সুরবেক বিশ্বাস ও
শিবাজী দে সরকার |
আগে আগে চলেছেন বোরখা পরা দু’জন ‘মহিলা’।
একটু দূরত্ব রেখে পিছন পিছন শক্তপোক্ত চেহারার ৭-৮ জন পুরুষ।
বোরখা পরা ‘মহিলাদের’ এক জন ইশারা করলেন এক দিকে।
তড়িঘড়ি সে-দিকে পা চালাল পিছনের দলটি।
বোরখা পরা ওই দু’জন আসলে মহিলা নন। দু’জনেই পুরুষ। গার্ডেনরিচ থানার দুই পুলিশকর্মী। বিভিন্ন ঘটনার তদন্তে পুলিশকে ছদ্মবেশ নিতে হয়। এটা তেমনই।
গার্ডেনরিচের গোলমালে মূল অভিযুক্ত মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না এবং তাঁর এক ঘনিষ্ঠ শাগরেদের সন্ধানে শুক্রবার এ ভাবেই তল্লাশি চালায় পুলিশ। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, উত্তরপ্রদেশে পালানোর মতলব এঁটেছেন মুন্না। পরে গোয়েন্দারা জানান, মুন্না এ দিনই পটনায় পালিয়ে গিয়েছেন। দু’-এক দিনের মধ্যে তিনি আইনজীবী মারফত আদালতে আগাম জামিনের আবেদনও করতে পারেন।
সিআইডি জানতে পারে, বৃহস্পতিবার মুন্নার মোবাইল ফোনের টাওয়ারের অবস্থান জানাচ্ছিল, তিনি আছেন হাওড়ার নাজিরগঞ্জে। ওই দিন এক মিনিটেরও বেশি সময় ধরে মুন্না তাঁর ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। বৃহস্পতিবার রাতে সিআইডি-র একটি দল ওই অভিযুক্তের আয়রন গেট রোডের বাড়িতে হানা দেয়। তাঁর বোনের সঙ্গে কথা বললেও মুন্না কোথায় আছেন, গোয়েন্দারা সেই বিষয়ে তেমন কিছু জানতে পারেননি।
মুন্নার খোঁজে শুক্রবার সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশন, ধর্মতলা বাস টার্মিনাস-সহ বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়। অভিযানে সিআইডি-র গোয়েন্দাদের সঙ্গে ছিলেন গার্ডেনরিচ থানার কর্মীরাও। সিআইডি সূত্রের খবর, গার্ডেনরিচ থানার দুই পুলিশকর্মী বোরখা পরে ছিলেন, বাকিরা সকলে ছিলেন সাধারণ পোশাকে।
একেবারে খালি হাতে ফেরায়নি বোরখা। কলকাতায় কেউ গ্রেফতার না-হলেও একই ছদ্মবেশে বর্ধমানের রায়না স্টেশনে কালকা মেলে তল্লাশি চালিয়ে ইকবালের ডানহাত চুড়ি ফিরোজ-সহ তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃত অন্য দু’জনের নাম রাজ ও শাকিল। গার্ডেনরিচে মঙ্গলবারের হাঙ্গামার ভিডিও ফুটেজ দেখে গোয়েন্দারা ওই তিন জনকে শনাক্ত করেন।
পুলিশকর্মীদের বোরখা পরিয়ে তল্লাশিতে নামানো হল কেন? |
|
সুনসান হরিমোহন ঘোষ কলেজে সরস্বতী পুজো। |
সিআইডি-র বক্তব্য, গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে অভিযুক্তেরা ভবানী ভবনের গোয়েন্দাদের চেনে না। কিন্তু উল্টো দিকেও সমস্যাটা একই। সিআইডি-র গোয়েন্দারাও গার্ডেনরিচের ওই অভিযুক্তদের চেহারার সঙ্গে পরিচিত নন। তাই রেল স্টেশন কিংবা বাস টার্মিনাসের মতো কোনও জনবহুল এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে তাদের ধরতে হলে যাঁরা ওই দুষ্কৃতীদের চেনেন, সেই গার্ডেনরিচ থানার পুলিশকর্মীদের সঙ্গে রাখা দরকার। সেখানেও সমস্যা আছে। দুষ্কৃতীরাও যে ওই পুলিশকর্মীদের চেনে! জনবহুল এলাকায় দূর থেকে তাঁদের দেখতে পেলে তারা পালিয়ে যেতে পারে। তাই গার্ডেনরিচ থানার দুই পুলিশকর্মীকে বোরখা পরিয়ে অভিযানে নামানো হয়। বিকেলে সিআইডি অনুরোধ জানায়, গার্ডেনরিচ থানা যেন বোরখার ব্যবস্থা করে রাখে। অভিযানে বেরোনোর আগে এক পুলিশকর্মী নিজের বাড়ি থেকে স্ত্রীর দু’টি বোরখা থানায় আনেন।
মুন্না ছাড়া আর কাকে ধরার জন্য ওই অভিযান চালানো হয়েছিল?
সিআইডি সূত্রের খবর, মুন্না ছাড়াও তাঁর ঘনিষ্ঠ শাগরেদদের অন্যতম চুড়ি ফিরোজকে ধরতেই এ দিন অভিযান চালানো হয়। গোয়েন্দারা খবর পেয়েছিলেন, ফিরোজ গাজিয়াবাদে পালানোর চেষ্টা করছে। পুলিশ জানায়, মঙ্গলবারের হাঙ্গামায় ফিরোজই প্রথমে দু’টি বোমা ছোড়ে এবং রটিয়ে দেয় যে, প্রতিপক্ষ মোক্তারের দল বোমা ছুড়ে গণ্ডগোল পাকাতে শুরু করেছে। ওই ছুতোয় বিবদমান দু’পক্ষের মাঝখানে থাকা গার্ডেনরিচ থানার ওসি রাম থাপা এবং গার্ডেনরিচ থানার পুলিশের দলটিকে ফিরোজেরা অন্যত্র ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করে। সেই সুযোগেই আরও বেশি করে বোমাবাজি ও গুলি ছোড়া শুরু হয়। নিহত হন কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী।
পুলিশ জেনেছে, মুন্না ও মোক্তারের দল সে-দিন মোট সাত রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল, বোমা ফাটায় সাতটি। পুলিশি সূত্রের বক্তব্য, সাতটি গুলিই ওয়ান-শটার থেকে চালানো হয়েছিল। তবে সানু নামে মুন্নার এক শাগরেদ ঘটনার দিন মুঙ্গেরে তৈরি নাইন এমএম পিস্তল নিয়ে এলাকায় ঘুরছিল। তদন্তকারীদের বক্তব্য, শেখ সুহানের হাতে থাকা ওয়ান-শটারের গুলিতে মারা যান তাপসবাবু। সিআইডি-র কাছে এখন ওই আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারই সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সুহান অস্ত্রটি কোথায় রেখেছে বা ফেলে দিয়েছে কি না, এখনও তা জানা যায়নি।
শুক্রবার বেলা আড়াইটে নাগাদ সিআইডি-র স্পেশ্যাল আইজি বিনীত গোয়েলের নেতৃত্বে গোয়েন্দাদের একটি দল গার্ডেনরিচের পাহাড়পুর রোডে সে-দিনের ঘটনাস্থলে যায়। ছিলেন কলকাতা পুলিশের ডিসি (বন্দর) ভি সলোমন ও গার্ডেনরিচ থানার অফিসারেরা। গোয়েন্দারা হরিমোহন ঘোষ কলেজেও ঢোকেন। গোয়েন্দারা গার্ডেনরিচ থানার অফিসারদের কাছে জানতে চান, এসআই তাপসবাবু ঠিক কোন জায়গায় গুলিবিদ্ধ হন। স্পেশ্যাল আইজি-র নেতৃত্বে গোয়েন্দারা ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন। অশান্তির সময়ে পুলিশকর্মীরা কোথায় ছিলেন, তদন্তকারীরা তার খোঁজ নেন। |
|
পাহাড়পুর এলাকা পরিদর্শনে গার্ডেনরিচ পুলিশের সঙ্গে
ডিআইজি (সিআইডি) বিনীত গোয়েল। শুক্রবার। |
পরে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে বসে সিআইডি। তদন্তভার তাঁদের হাতে এলেও এ ক্ষেত্রে বারবার যে-তল্লাশি অভিযান চালাতে হবে, তার পরিকাঠামো সিআইডি-র নেই বলে ভবানী ভবনের কর্তারা বৈঠকে স্বীকার করে নেন। অভাব লোকবলেরও। তাই সব রকম সহযোগিতা করার জন্য কলকাতা পুলিশকে অনুরোধ জানান তাঁরা। সিআইডি-র এক কর্তা জানান, সরকারি নির্দেশে সিআইডি তদন্তভার নিয়েছে ঠিকই। তবে তদন্তের কাজ, বিশেষ করে দুষ্কৃতীদের হদিস পাওয়া, তাদের গ্রেফতার করার মতো কাজ পারস্পরিক সহযোগিতা বজায় রেখে যৌথ ভাবেই করতে হবে।
সিআইডি-র চিন্তা ছিল, একই সঙ্গে পুলিশ কমিশনারকে বদলি করা এবং গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের তদন্তভার কেড়ে নেওয়ার ফলে চূর্ণ হয়ে যাওয়া মনোবল নিয়ে কলকাতা পুলিশ কী ভাবে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে! তবে লালবাজারের গুন্ডা দমন শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বৈদ্যনাথ সাহা এ দিন সকালেই তদন্তের গতিপ্রকৃতি বিস্তারিত ভাবে সিআইডি-কে জানিয়ে দেন। এ ভাবেই শুরু হয় সহযোগিতা। পুলিশ অফিসার খুনের মামলায় যেমন মুন্না-সহ ৫-৬ জন অভিযুক্ত, তেমনই দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানো এবং খুনের চেষ্টার মামলায় মুন্না ও মোক্তার ছাড়া আরও প্রায় ১৩০ জন অভিযুক্ত বলে জেনেছে সিআইডি। কলকাতা পুলিশ, বিশেষত গার্ডেনরিচ থানার সহযোগিতা ছাড়া ভবানী ভবনের পক্ষে তাদের গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, তাদের নাম জানাও মুশকিল। কলকাতা পুলিশই এ দিন সিআইডি-কে মুন্না ও মোক্তার ছাড়া কালো, সানু, ফৈয়াজ, ইকবাল (মুন্না নন), শামিম, টাকলা জাহাঙ্গির, তবরেজ, মোস্তাক, আলির মতো অভিযুক্তদের নাম জানিয়ে দেয়।
যে-হরিমোহন ঘোষ কলেজকে ঘিরে হাঙ্গামা, সেখানে সরস্বতী পুজো হলেও অন্যান্য বারের মতো জাঁকজমক ছিল না। পুলিশের বক্তব্য, জনা কুড়ি পড়ুয়া উপস্থিত হয়েছিলেন। শ’খানেক বহিরাগত দর্শকও হাজির ছিলেন পুজোয়। কিন্তু আলোকসজ্জা, মাইকের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
|
—নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|