আকাশে তীব্র আলোর একটা ঝলকানি ছুটে চলেছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সঙ্গে বিকট শব্দ। পলকের মধ্যে ভেঙে পড়ছে বাড়ির জানলা, দরজা।
দৃশ্যটা অনেকটাই মেলে ব্রুস উইলিস অভিনীত হলিউডি সিনেমা ‘আর্মাগেডন’-এর সঙ্গে। কিন্তু বাস্তবে এমন ছবিটাই ধরা পড়েছে মধ্য রাশিয়ার উরাল অঞ্চলে চেলিয়াবিনস্কে। সে দেশের সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, উল্কাপাতে ওই অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়ির জানলা-দরজা ভেঙে প্রায় দেড় হাজার জন আহত হয়েছেন। যার মধ্যে অন্তত দু’শো শিশু রয়েছে। একশোরও বেশি আহতকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি দস্তা কারখানা-সহ হাজার তিনেক বাড়িঘর। |
সকাল সওয়া ন’টা। চেলিয়াবিনস্কের আকাশে হঠাৎ ছুটে এল তীব্র আলোর রেখা।
সঙ্গে ধোঁয়ার লেজ আর বিকট শব্দ। ড্যাশবোর্ড ক্যামেরায় ধরা পড়ল দৃশ্য। |
কী এই উল্কাপাত? কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের অধিকর্তা সঞ্জীব সেন জানান, মহাকাশে ভাসমান ধূলিকণা থেকে শুরু করে ছোটখাটো পাথরের টুকরো ভেসে বেড়ায় (কখনও অবশ্য তার সঙ্গে ধাতুও মিশে থাকে)। এ ভাবে ভেসে বেড়ানোর সময় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতরে ঢুকে পড়ে। এ সময় বায়ুর সঙ্গে ঘর্ষণে সেগুলি জ্বলে ছাই হয়ে যায়। এগুলিই উল্কা। যা চলতি ভাষায়, খসে যাওয়া তারা হিসেবেই পরিচিত। তবে কোনও কোনও উল্কা পুরো ছাই হওয়ার আগে ভূখণ্ডে এসে ধাক্কা খায়। সেই ঘটনাকে বলা হয় উল্কাপাত। এমন ঘটনা আগে থেকে আন্দাজ করা সম্ভব নয় বলেও বিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি।
উরাল অঞ্চলে এ দিনের ঘটনাটিই উল্কাপাত বলেই দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, ঘটনার পর ওই এলাকার মাটিতে টুকরো-টুকরো উল্কাখণ্ড ছড়িয়ে রয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে। |
উল্কাখণ্ডের আঘাতে ২০ ফুট গভীর গর্ত হয়েছে শহরের কাছে
বরফ-ঢাকা একটি হ্রদে। গর্তের পাশেই দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা। |
ঠিক কী ঘটেছে সেখানে? মস্কো থেকে ১৫০০ কিলোমিটার দূরের চেলিয়াবিনস্ক শহরের বাসিন্দা জানাচ্ছেন, তখন সকাল সওয়া ন’টা। দিনের আলো ভাল করে ফোটেনি। তার মধ্যেই অবশ্য কাজেকর্মে যোগ দিতে রাস্তায় বেরিয়েছেন বাসিন্দারা। হঠাৎই আকাশে ছুটে এল একটি তীব্র আলোর রেখা। সঙ্গে বিরাট ধোঁয়ার লেজ আর একটা বিকট শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেঙে পড়তে লাগল কাচের জানলা-দরজা। রেহাই পেল না ঘরবাড়িও। ভেঙে পড়া কাচ ও বাড়ির আঘাতে আহত হলেন রাস্তায় বেরোনো লোকজন। স্থানীয় বাসিন্দা, ভিক্টর প্রোকোফিয়েভ সংবাদসংস্থাকে জানিয়েছেন, “গাড়ি চালিয়ে অফিস যাচ্ছিলাম। হঠাৎই চোখ ধাঁধিয়ে গেল আকাশে আলোর ঝলকানিতে। পলক ফেলতেই চার দিকে ঝনঝন করে কাচ ভেঙে পড়তে লাগল।”
রাশিয়ার প্রশাসন জানিয়েছে, এই ঘটনায় বিদ্যুৎ, জনসংযোগ ব্যবস্থা-সহ জরুরি পরিষেবার কোনও ক্ষতি হয়নি। তবে ওই এলাকায় উদ্ধারকারী দল পাঠানো হয়েছে। ঘটনার পরপরই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভকেও বিষয়টি জানানো হয়। পুতিন ওই এলাকায় অবিলম্বে সাহায্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। একটি সূত্র জানাচ্ছে, চেলিয়াবিনস্ক অঞ্চলে একাধিক শিল্প কারখানা রয়েছে। রয়েছে পরমাণু কেন্দ্র ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের গুদামও। সে কারণে ওই এলাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। |
উল্কাপাতের কম্পন ও পাথরের আঘাতে ভেঙেছে বাড়িঘর, কাচের জানলা।
আহত হয়েছেন অনেকে। একটি কারখানায় চলছে মেরামতি। |
বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাশিয়ায় এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। ১৯০৮ সালে সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কায় উল্কাপাতের ফলে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার জুড়ে গাছপালা পুড়ে যায়।
প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্রতি সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার বেগে ছুটে আসা বিরাট উল্কাটি মাটি থেকে অন্তত ৩০ কিলোমিটার উপরেই জ্বলে গিয়েছিল। সেই বিস্ফোরণের অভিঘাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাড়িঘর। পাশাপাশি জ্বলে যাওয়ার উল্কাটির অবশিষ্ট টুকরো অবশ্য পৃথিবীতে এসে ধাক্কা খেয়েছে।
ঘটনাচক্রে এ দিন মাঝরাতেই পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে একটি ‘২০১২ ডিএ১৪’ নামে একটি গ্রহাণুর ছুটে যাওয়ার কথা। তা হলে কি এ দিন রাশিয়ার ঘটনার সঙ্গে সেই গ্রহাণুর কোনও সম্পর্ক রয়েছে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, একই দিনে দু’টো ঘটনা কাকতালীয়। তাঁদের কথায়, “গ্রহাণুটির গতিপথ থাকবে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে। এ দিনের উল্কাটি এসেছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। ফলে সম্পর্ক থাকা অসম্ভব।”
|