মেয়াদ অনন্ত, কমিশন খাতে ইতিমধ্যেই ৫ কোটি |
কমিশন তো নয়, যেন হাতি পোষা!
নতুন সরকারের বাইশ মাসে বিভিন্ন বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের পিছনে রাজ্যের কোষাগার থেকে খরচ হয়ে গিয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। যদিও এ পর্যন্ত একটামাত্র কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়েছে। মহাকরণের খবর, রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসা ইস্তক ১১টি বিচারবিভাগীয় কমিশন গড়া হয়েছে। একটির রিপোর্ট জমা পড়লেও কাজ চলছে পাঁচটির। বাকি পাঁচটা কাজ শুরুই করে উঠতে পারেনি! “সব কমিশন এক সঙ্গে কাজে নামলে খরচের বহর কোথায় দাঁড়াবে, সহজেই অনুমেয়।” মন্তব্য করছেন স্বরাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র।
সরকারে এসে বিশেষত বাম জমানার বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে তিনি অনেকটাই এগিয়েছেন। কিন্তু সমস্যায় পড়েছে স্বরাষ্ট্র দফতর। স্বরাষ্ট্র-সূত্রের খবর: একটি কমিশনকে তদন্ত করে রিপোর্ট পেশের জন্য ছ’মাস সময় দেওয়া হয়। তাতে কাজ না-হলে সময়সীমা আরও ছ’মাস বাড়ানো হয়। এ ভাবে রিপোর্ট জমা না-পড়া পর্যন্ত ছ’মাস করে মেয়াদ বাড়িয়ে যায় সরকার। সেই সঙ্গে খরচের বহরও বাড়ে। সরকারি তথ্য বলছে, ২০১২-র ডিসেম্বরে তেহট্টে গুলিচালনার তদন্তে গঠিত কমিশনটি ছাড়া অন্যগুলোর মেয়াদ ছ’মাস তো বটেই, এমনকী কয়েকটির ক্ষেত্রে বছরও পেরিয়ে গিয়েছে।
এবং ঘটনা হল, কমিশনের পেশ করা রিপোর্টের সুপারিশ সরকার যে মানবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই এত টাকা খরচ করে এতগুলো কমিশন গঠন আদৌ ফলপ্রসূ হবে কি না, সে সংশয় দানা বেঁধেছে প্রশাসনের অন্দরে। ব্যয়ের ছবিটা কি রকম?
স্বরাষ্ট্র-তথ্য অনুযায়ী, একটি বিচারবিভাগীয় কমিশনকে কাজ চালাতে প্রতি ছ’মাসের জন্য সরকার দিচ্ছে সাড়ে ৩৫ লক্ষ টাকা। সেই টাকায় কমিশনের চেয়ারম্যান, সচিব, সহ-সচিব, সেকশন অফিসার, দু’জন স্টেনো, দু’জন প্রসেসর ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের (সব মিলিয়ে ৮-১০ জন) বেতন, গাড়ির খরচ, টেলিফোনের খরচ ইত্যাদি মেটানো হয়। সঙ্গে রয়েছে আসবারপত্র কেনা ও দৈনন্দিন খরচ।
|
তদন্ত-তালিকা |
কমিশন |
ঘটনা |
কবে চালু |
কী অবস্থা |
বিচারপতি অরুণাভ বসু |
১৯৭০-এ
বর্ধমানের সাঁইবাড়ি গণহত্যা |
২০ জুলাই ২০১১ |
চলছে |
বিচারপতি ডি পি সেনগুপ্ত |
২০১১-য়
বিধায়ক মোস্তাফা কাশিমের মৃত্যু |
২৬ জুলাই ২০১১ |
রিপোর্ট জমা |
বিচারপতি গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্য |
২০০৮-এ
দাসপুরে বিডিও কল্লোল শূরের মৃত্যু |
১ ডিসেম্বর ২০১১ |
চলছে |
বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় |
১৯৯৩-এ
একুশে জুলাইয়ের গুলিচালনা |
১৮ ডিসেম্বর ২০১১ |
চলছে |
বিচারপতি তপন মুখোপাধ্যায় |
২০১১-য়
আমরি হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ড |
১ জুন ২০১২ |
চলছে |
বিচারপতি প্রবীর সামন্ত |
২০১১-য়
মগরাহাটে পুলিশের গুলি |
২৩ জুলাই ২০১২ |
চলছে |
বিচারপতি রণেন্দ্রনারায়ণ রায় |
রাজারহাটে জমি বণ্টনে অনিয়মের অভিযোগ |
২০১১-র ডিসেম্বরে বিজ্ঞপ্তি |
কাজ চালু হয়নি |
বিচারপতি সন্তোষকুমার ফৌজদার |
১৯৮২-তে
আনন্দমার্গীদের পুড়িয়ে মারা |
২০১২-র মার্চে বিজ্ঞপ্তি |
কাজ চালু হয়নি |
বিচারপতি অসিত বিশি |
১৯৭১-এর
কাশীপুর-বরাহনগর গণহত্যা |
২০১২-র মার্চে বিজ্ঞপ্তি |
কাজ চালু হয়নি |
বিচারপতি এন এন ভট্টাচার্য |
১৯৯৯-এ
গড়বেতায় হুল উৎসবে মৃত্যু |
২০১২-র মার্চে বিজ্ঞপ্তি |
কাজ চালু হয়নি |
বিচারপতি অজয়নাথ সেন |
২০১২-য়
তেহট্টে গুলিচালনা |
২০১২-র ডিসেম্বরে বিজ্ঞপ্তি |
কাজ চালু হয়নি |
|
মহাকরণের খবর: সিপিএমের বিধায়ক মুস্তাফা বিন কাশেমের অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তে গঠিত বিচারবিভাগীয় কমিশনের রিপোর্ট এক বছরের মধ্যে জমা পড়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, বিধায়ক আত্মহত্যা করেছেন। ওই কমিশনটি চালাতে সরকারের খরচ হয়েছে ৭১ লক্ষ টাকা। ঘোষিত বাকি দশটি কমিশনের মধ্যে তিনটির মেয়াদ এক বছর পেরিয়েছে, দু’টি ছ’মাস অতিক্রম করেছে। বাকি পাঁচটা কাজই শুরু করেনি। তাই এদের পিছনে এখনও টাকা খরচের প্রশ্ন নেই। তবে চালু কমিশনগুলোর পিছনেই এ যাবৎ সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। মুখপাত্রটি জানান, সল্টলেকের ইন্দিরা ভবনে কয়েকটি কমিশন বসবে বলে স্থির হয়েছে। আবার দু’টো কমিশনের জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নাম ঘোষণা করা হলেও তাঁরা রাজি নন। পরিবর্ত কোনও নাম সরকার এখনও ঠিক করতে পারেনি।
বিচারবিভাগীয় কমিশনের প্রেক্ষিতকে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য শুধু বাম আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর সরকারের ঘোষণায় যেমন ২০১১-র আমরি-অগ্নিকাণ্ডের তদন্তে কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে, তেমন বিয়াল্লিশ বছরের পুরনো বর্ধমান সাঁইবাড়ি গণহত্যা নিয়েও তদন্ত কমিশন গঠিত রয়েছে। পাশাপাশি বিচারবিভাগীয় তদন্তের তালিকায় রয়েছে রাজারহাটে হিডকোর জমি-ফ্ল্যাট বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ, বিজন সেতুতে আনন্দমার্গী হত্যাকাণ্ড, গড়বেতায় হুল দিবসে পথ দুর্ঘটনায় সাঁওতাল-মৃত্যু, ১৯৯৩-এর একুশে জুলাই মহাকরণ অভিযানে পুলিশের গুলিচালনা ইত্যাদি।
মহাকরণের খবর: আপাতত কয়েকটি কমিশনের কাজ চলছে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের এক সরকারি বাড়িতে। এ বার ইন্দিরা ভবনে পরিকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু টাকার অভাবে আসবাব কেনা আটতে যেতে বসেছে। ফলে বিজ্ঞপ্তি জারির পরেও পাঁচটি কমিশনের কাজ শুরু করা যায়নি। এক স্বরাষ্ট্র-কর্তার কথায়, আগামী অর্থবর্ষের বাজেটে বাড়তি টাকা মিললে সমস্যা মিটতে পারে। নচেৎ এ ভাবেই চলবে। |