কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে এর আগে উদ্যোগী হয়েছিলেন বিচারপতিরা। এ বার বনধ মোকাবিলাতেও কড়া দাওয়াই দিল কলকাতা হাইকোর্ট।
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ডাকা ২০ এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করল কলকাতা হাইকোর্ট। ওই দু’দিন জনজীবন সচল রাখতে রাজ্য সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে তারা। বিচারপতিদের মতে, বারবার বনধ ডাকায় রাজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। তাই বন্ধের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত বলে মনে করছেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির ডিভিশন বেঞ্চ।
আইনজীবী ইদ্রিশ আলি-সহ আরও তিন জন দু’দিনের বন্ধের বিরোধিতা করে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিলেন। বিভিন্ন পক্ষের সওয়াল শেষে বৃহস্পতিবার ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, বন্ধের দিনে কোনও ব্যক্তি আহত হলে কিংবা কারও সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে দায়ী ব্যক্তি বা সংগঠনকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আহত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের জন্য সরাসরি হাইকোর্টের কাছে আবেদন জানাতে পারবেন। শুধু সেই জন্যই এ দিন ওই মামলার নিষ্পত্তি করা হল না বলেও জানিয়ে দেন বিচারপতিরা। জনজীবন সচল রাখার জন্য রাজ্য সরকারকে হাইকোর্টের নির্দেশ, জরুরিকালীন পরিষেবার মধ্যে স্কুল, কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালতকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিল্পের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানকেও নিরাপত্তা দিতে হবে।
আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনকে হলফনামা দিয়ে তাদের বক্তব্য জানাতে হবে। দু’সপ্তাহের মধ্যে আবেদনকারীদের উত্তর দিতে হবে। ছয় সপ্তাহ পরে মামলাটির ফের শুনানি হবে। |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ইতিমধ্যেই বনধ-বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। রাজ্য সিপিএমের অন্দরেও টানা দু’দিনের ধর্মঘটের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যার প্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসকে উপলক্ষ করে পরিবহণে ছাড় দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য সিটু। এই আবহে আদালতের এ দিনের মনোভাব রাজ্যে ধর্মঘট-বিরোধী জনমত তৈরি করতে আরও সহায়ক হবে বলেই শিল্প ও বণিক মহলের একাংশের আশা।
তবে হাইকোর্টের এই আদেশের জেরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে ধর্মঘটীদের তরফে। এবং সকলেই চেষ্টা করেছে, নিজেদের কর্মসূচিকে হাইকোর্টের নির্দেশের এক্তিয়ারের বাইরে নিয়ে গিয়ে দেখাতে! সারা দেশে দু’দিনের সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছে ১১টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন। তাদের তরফে এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক গুরুদাস দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন আদালতের নির্দেশকে গ্রাহ্য না-করে সর্বাত্মক ধর্মঘট করার জন্য! কলকাতায় এ দিন গুরুদাসবাবু বলেন, “বন্ধের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে। যদি হাইকোর্ট সেই কথাই বুঝিয়ে থাকে, তা হলে কিছু বলার নেই। আমরা সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছি, বনধ নয়। ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার কোনও অধিকার বিচার বিভাগের নেই। ধর্মঘটকে নিষিদ্ধ করার আদেশ আদালত দিলে সেই অসাংবিধানিক রায় আমরা মানি না!” গুরুদাসবাবুর আরও বক্তব্য, “ওই রায়কে কাগজের টুকরোর মতো মনে করে ধর্মঘটে যোগ দিন! আমি সংসদের সদস্য হিসাবে প্রকাশ্যেই এই কথা বলছি। এতে আদালত অবমাননা হয়েছে মনে করে থাকলে ওয়ারেন্ট জারি করা হোক! আমার ঠিকানা সকলেই জানেন!”
ধর্মঘট করলেও তাঁরা শান্তিপূর্ণ ভাবেই তা পালন করবেন বলে অবশ্য গুরুদাসবাবু জানিয়েছেন। সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তীর মতে, “আইনজীবীদের কাছে যা শুনেছি, হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে বনধ নিয়ে। আমরা ডেকেছি সাধারণ ধর্মঘট।” ধর্মঘটী সবক’টি সংগঠনের বক্তব্য আদালত শুনবে বলেও জানিয়েছেন শ্যামলবাবু। রাজ্য আইএনটিইউসি-র সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য হাইকোর্টের মনোভাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তাঁর বক্তব্য, “তিনটি কেন্দ্রে উপনির্বাচনের আগে সিটুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমরা এ রাজ্যে সাধারণ ধর্মঘট করতে পারব না। আমরা করব শিল্প ধর্মঘট। এই নির্দেশের প্রভাব আমাদের উপরে পড়ার কথা নয়।”
তাঁরা ২০-২১ তারিখ বনধ ডেকেছেন কি না, তা সিটুর আইনজীবী নিশীথ অধিকারীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি মিশ্র। নিশীথবাবু বলেন, তাঁরা বনধ ডাকেননি। দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য শ্রমিকদের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার আবেদন জানিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হননি। তিনি জানতে চান, ওই দু’দিন যাঁরা কাজে যোগ দিতে চান কিংবা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে চান, তাঁদের বাধা দেওয়া হবে কি না। নিশীথবাবু বলেন, কাউকেই জোর করা হবে না।
বিচারপতি জয়মাল্যবাবু বলেন, শ্রম-বিরোধ নিষ্পত্তি আইনে শ্রমিকদের ধর্মঘটে যাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু কোনও সংগঠন বা রাজনৈতিক দল শ্রমিকদের ধর্মঘটে যেতে বাধ্য করতে পারে না। জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সরকার বন্ধের বিরোধী। বন্ধের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট ও অন্য আদালতের রায়ের ভিত্তিতেই তারা এ দিনের নির্দেশ দিয়েছে বলে জানিয়েছে বেঞ্চ। এই নির্দেশকে কেন্দ্র করে আরও কড়া হবে রাজ্য সরকার। পাল্টা প্রতিক্রিয়া হতে পারে ধর্মঘটীদের। মানুষ কী ভূমিকা নেবেন, প্রশ্ন সেটাই! |