বামফ্রন্টের বিকল্প নেই, বলছে সমীক্ষা
পাঁচ বছরের দুঃস্বপ্ন আর মানিকই সাফল্যের রসায়ন
প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা।
সেই ১৯৮৮ সালে এ রকমই ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখে বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছিল ত্রিপুরায়। আগরতলা শহরে আগের রাতে জঙ্গি হানায় প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ। ১১টি অস্থিকলস সারিবদ্ধ। আর ঠিক তার পাশেই একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ভোটদাতাদের সুদীর্ঘ লাইন। চার দিকে পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনী, এমনকী সেনাও ঘোরাঘুরি করছে। এই প্রতিবেদক সাক্ষী ছিলেন এক নিঃশব্দ বিপ্লবের। মানুষ কথা বলছিল না। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীর ১০ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হলেন সুধীর মজুমদার।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত বোনের মধ্যে ত্রিপুরাতেও সে দিন ছিল ভয়াবহ সন্ত্রাসের আবহ। বিজয় রাঙ্খলের নেতৃত্বাধীন টিএনভি-র ভয়াবহ সন্ত্রাসলীলা চলছে। সন্ত্রাস মোকাবিলায় ব্যর্থ সিপিএম। বাঙালি এবং উপজাতি সংঘর্ষে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও সিপিএমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসেছেন। রাজভবনের উল্টো দিকে সার্কিট হাউসে বসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর নিযুক্ত কংগ্রেসের পর্যবেক্ষক-নেতা এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব হাতের সামনে একটি বিশাল মানচিত্র খুলে দেখছেন কোথায় কোথায় উপদ্রুত এলাকা। কী ভাবে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আর সন্তোষবাবুর সঙ্গী সে দিনের আন্দামানের সাংসদ মনোরঞ্জন ভক্ত।
ক্ষমতায় আসার পরে কিন্তু দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাল কংগ্রেস সরকার। জরুরি অবস্থা-বিরোধী পরিস্থিতিতে ১৯৭৭ সালে ত্রিপুয়ায় যখন সিপিএম প্রথম ক্ষমতায় আসে, তখন বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে একটিও পায়নি কংগ্রেস! এর পরে দীর্ঘ বাম শাসনে সমস্যা যে ছিল না, তা নয়। সিপিএমের মধ্যেও বাঙালি নেতা নৃপেনবাবুর সঙ্গে তৎকালীন উপমুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেবের মতপার্থক্য ছিল সুবিদিত। তখনও দলের মধ্যে ক্ষমতার অহঙ্কার ও বাইরে দলতন্ত্রের অসুখ ছড়িয়ে পড়ছিল।

ভোট দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। বৃহস্পতিবার
আগরতলার একটি বুথে। ছবি: উমাশঙ্কর রায়চৌধুরী
কিন্তু ক্ষমতা বদলের পরে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সুধীরবাবুর সঙ্গে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমীররঞ্জন বর্মণের যে বিরোধ দেখা গেল, তা অভূতপূর্ব। কংগ্রেসের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব তীব্র আকার নিল। যে ‘ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতি’র (টিইউজেএস) সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিলেন সন্তোষমোহনেরা, ক্ষমতায় আসার পর সেই উপজাতি সংগঠনের সঙ্গে কংগ্রেসের সংঘাত চরমে উঠল। দুর্নীতি পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠল। রাজীব তখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে চুক্তি করে তাঁদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। রাঙ্খলকে ভোটের পরেই দিল্লিতে ডেকে এনে তাঁর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পাঁচ বছরেই মানুষ ক্ষুব্ধ, বিরক্ত হয়ে ছুড়ে ফেলে দিল কংগ্রেসের সেই রাজ্য সরকারকে!
বাংলাদেশ সীমান্তে এই ছোট্ট রাজ্যটিতে সিপিএম আবার ফিরে এল দশরথবাবুর নেতৃত্বে। নৃপেনবাবু বিদ্রোহ করলেন। এত দিনের প্রবীণ নেতাকেও দল-বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কৃত হতে হল। এই পরিস্থিতিতেই সিপিএমের পালে নতুন বাতাস নিয়ে অবতীর্ণ হলেন মানিক সরকার। পরের নির্বাচনে তিনিই হলেন মুখ্যমন্ত্রী।
কে এই মানিক সরকার?
পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এই মানুষটিকে তাঁর কট্টর কোনও বিরোধী নেতাও কিন্তু ‘অসৎ’ বলে অভিযোগ করেন না। আগরতলা শহরের বুকে তখনও দেখতাম, দলের এই নবীন নেতাটির সে দিন খুব অনাড়ম্বড় জীবনযাত্রা ছিল। কখনও কখনও নৃপেনবাবুর সঙ্গেও তাঁর মতপার্থক্য হয়েছে। কিন্তু নৃপেনবাবু আবার অত্যন্ত স্নেহও করতেন মানিকবাবুকে। এক বার রসিকতা করে বলেছিলেন, “অতীতে ত্রিপুরায় ছিল মাণিক্য রাজ। আর আগামী দিনের রথের রশি নিয়ন্ত্রণ করবে আমাদের মানিক!” এই ২০১৩-য় জিতলে টানা পাঁচ বার বামফ্রন্ট সরকার তৈরি হবে ত্রিপুরায়। আর এ বারের ভোটপর্বে যাবতীয় সমীক্ষা বলছে, সিপিএমই ক্ষমতায় আসবে। তার প্রধান কারণ, ‘টিনা’ (দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ) সূত্র। অর্থাৎ মানিক-সরকারের কোনও বিকল্প নেই।
তৃণমূল ত্রিপুরায় শুরু করেছিল। কিন্তু শেষ করতে পারেনি। এ বারে কোনও প্রার্থীই নেই তাদের। কংগ্রেস ছত্রভঙ্গ। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সমীরবাবুর পুত্র সুদীপ রায় বর্মণ রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি। কিন্তু মানুষ এখনও কংগ্রেসকে ‘বিকল্প’ হিসাবে ভাবতে পারছে না। সেই পাঁচ বছরের ‘দুঃস্বপ্নে’র স্মৃতি সাধারণ মানুষ ভুলে গিয়ে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় আনতে এখনও উৎসাহী নয়।
তবে মানিকবাবু এই প্রতিবেদককে বলেছেন, “কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যক্তির চেয়ে নীতি এবং মতাদর্শ অনেক বড় বিষয়। এখানে আমি কোনও ব্যাপার নই। দয়া করে আমাকে আর আপনারা বেশি প্রচার দিয়ে অহঙ্কারী করে দেবেন না!” সিপিএম নেতারা বলেন, আসলে ত্রিপুরায় সিপিএমের বিকাশ হয়েছে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। গণমুক্তি পরিষদের নেতা ছিলেন দশরথবাবু। তাঁর নেতৃত্বে উপজাতিদের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা হয়েছে। পাঁচের দশকে নৃপেনবাবুকে আগরতলায় পাঠিয়েছিলেন মুজফ্ফর আহমেদেরা (কাকাবাবু)। হয়তো বাঙালি নেতৃত্বের সঙ্গে উপজাতি সংগঠনের সংহতি আনারও একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। বাঙালি এবং উপজাতি নেতৃত্বের একটি দ্বন্দ্ব ভিতরে ভিতরে থেকে গেলেও এই দুই নেতা কিন্তু সফল ভাবে একটা সমন্বয় সাধনও করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু সন্ত্রাসের আবহ গোটা পরিস্থিতিকেই ‘৮৮ সালে আমূল বদলে দিয়েছিল আকস্মিক ভাবে। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেন মানিকবাবু ও তাঁর দল। উপজাতি বিচ্ছিন্নতার ওষুধ খোঁজেন নতুন করে। আর পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়েও সাবধানে পা ফেলেন তিনি। ফলে শিল্পায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে এগোনো, আর কৃষক-শ্রমিকদের নিরাপত্তা দু’টো দিকেই ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ ভাবে বিদ্যুৎ প্রকল্প করছেন। আনারসের রফতানিতে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। আবার গরিব চাষির কন্ঠের সঙ্গেও সুর মেলানোর চেষ্টা করেছেন। ‘লো-প্রোফাইল’ নেতা মানিকবাবু মনমোহন সিংহ থেকে মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার যেমন প্রিয়, তেমনই নিজের দলে প্রকাশ কারাটেরও বিশেষ কাছের লোক।
ভোটের ফলাফল কী হবে, এখনও অজানা। কিন্তু আগরতলার মানুষ এ কথা স্বীকার করেন যে, কংগ্রেসের ওই পাঁচ বছরের দৃষ্টান্ত আজও মানুষের কাছে এতটাই ‘দুঃস্বপ্ন’, সিপিএম যে সেখানে আরও কত বছর থাকবে কে জানে! আরও একটু এগিয়ে ত্রিপুরায় সিপিএম মুখপত্রের এক সাংবাদিকের প্রশ্ন, পরিবর্তনের পরে পশ্চিমবঙ্গে যে রাজত্ব চলছে, তাতে ত্রিপুরার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে না তো?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.