কপ্টার-কেলেঙ্কারি
বাজপেয়ী-জমানাকে নিশানা করছে কেন্দ্র
সালটা ১৯৮৪। লোকসভা নির্বাচনে ইলাহাবাদ কেন্দ্রে কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে লড়ছেন অমিতাভ বচ্চন। রাজীব গাঁধীর অনুরোধে ভোটের ময়দানে নামা মেগাস্টারের পাশে তখন দেখা যেত আর এক রাজীবকে। রাজীব ত্যাগী। দিল্লির এই ডাক্তারের তখন কংগ্রেসের উপর মহলে অবাধ ঘোরাফেরা।
জমানা বদলেছে। রাজীব গাঁধী থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ী হয়ে এখন মনমোহন সিংহের জমানা এই তিন দশকে রাজীব ত্যাগী ও তাঁর দুই ভাই, সঞ্জীব ওরফে জুলি এবং সন্দীপ বরাবরই ক্ষমতার করিডরে পরিচিত মুখ ছিলেন। এই তিন জনই প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধান এস পি ত্যাগীর পিসতুতো ভাই। ৩৬০০ কোটি টাকার হেলিকপ্টার-দুর্নীতিতে ত্যাগী-ভাইরা প্রায় ৭৬ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। হেলিকপ্টার-দুর্নীতিতে তিন ভাইয়ের নাম উঠে আসায় রাজধানীতে প্রশ্ন উঠেছে, আর কারা জড়িত ত্যাগী-ভাইদের সঙ্গে?
প্রতিরক্ষা দুর্নীতি এবং ইতালি-যোগ এই দুইয়ের ধাক্কায় ফের বফর্স কেলেঙ্কারির ভূত দেখতে শুরু করেছে কংগ্রেস নেতৃত্ব। এই অবস্থায় প্রধান বিরোধী দল বিজেপি-র আক্রমণ সামলাতে আজ তেড়েফুঁড়ে মাঠে নেমেছে ইউপিএ-সরকার। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি বরাবরই নিজের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির জন্য পরিচিত। কপ্টার-চুক্তির যাবতীয় নথি-তথ্য প্রকাশ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দাবি, দুর্নীতি কিছু হয়ে থাকলে তা হয়েছে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলেই। অভিযোগ, ভিভিআইপিদের জন্য কপ্টার কেনার গুণগত মাপকাঠি ওই আমলে এমন ভাবে বদলানো হয়েছিল, যাতে ইতালীয় সংস্থা ফিনমেকানিকা-র বরাত পেতে সুবিধা হয়। আজ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, এনডিএ-জমানার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং বাজপেয়ীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি প্রয়াত ব্রজেশ মিশ্রই কপ্টারের গুণগত মাপকাঠি বদলের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এত দিন প্রাক্তন বায়ুসেনা-প্রধান এস পি ত্যাগীও এই দাবিই করছিলেন।
কপ্টার-দুর্নীতির শিকড় খুঁজতে আজ তদন্তে নেমেছে সিবিআই। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফেও ইতালীয় সংস্থা ফিনমেকানিকা-র ব্রিটিশ শাখা সংস্থা অগাস্টা-ওয়েস্টল্যান্ডের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, কপ্টারের বরাত পাওয়ার জন্য তারা ভারতে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থাকে ঘুষ দিয়েছিল কি না। বিদেশ থেকে ঘুষের টাকা ভারতে এলে, তা কোন পথে, কার কাছে পৌঁছেছে, তার হদিশ করতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকেও মাঠে নামানো হচ্ছে। ইতালি পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট বলছে, ৩৬০০ কোটি টাকার বিনিময়ে ১২টি কপ্টার বায়ুসেনাকে বিক্রির বরাত পেতে বরাত-মূল্যের সাড়ে সাত শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩৬২ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার প্রস্তুতি ছিল ফিনমেকানিকা-র। তাদের দাবি, এর মধ্যে ভারতে ঢুকেছে অন্তত ১৩৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৭৬ কোটি টাকা গিয়েছে ত্যাগী-ভাইদের সিন্দুকে! ইতালীয় তদন্তকারীরা সেখানকার আদালতে একটি রিপোর্টও জমা দিয়েছেন। তাতে তাঁরা জানিয়েছেন, এডিআর নামে এক জন মধ্যস্থতাকারী জানিয়েছেন, তিনি অন্তত ছয় থেকে সাত বার প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধান এস পি ত্যাগীর সঙ্গে দেখা করেছেন। যদিও ত্যাগী সেই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দাবি, ভিভিআইপি-দের জন্য অত্যাধুনিক সুরক্ষা ব্যবস্থা সমৃদ্ধ হেলিকপ্টার কেনা নিয়ে চিন্তাভাবনার শুরু ১৯৯৯ সালে। জর্জ র্ফানান্ডেজ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে বেশ কয়েক বার ৬ হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত সিয়াচেন হিমবাহে গিয়েছিলেন। তার পরেই ঠিক হয়, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের যাতায়াতের জন্য এমন কপ্টার কেনা উচিত, যা অন্তত ৬ হাজার মিটার উঁচুতে উড়তে পারে। কিন্তু পরে ঠিক হয়, সাড়ে ৪ হাজার মিটার উচ্চতায় ওড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন কপ্টারই যথেষ্ট। নিরাপত্তার স্বার্থে কপ্টারের কেবিনের উচ্চতাও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ত্যাগীর দাবি, তিনি বায়ুসেনা প্রধান হন ২০০৫ সালের জুনে। তার আগেই ২০০৩ সালে কপ্টারের গুণগত মাপকাঠি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ব্রজেশ মিশ্রই এই নির্দেশ দেন। বায়ুসেনা, এসপিজি, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের নির্দেশেই তা কার্যকর হয়।
এনডিএ-সরকারের ঘাড়ে দায় ঠেলতে চাইলেও সরকারি স্তরে দুর্নীতি হয়েছে বলে এখনও মানতে নারাজ অ্যান্টনি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের দাবি, প্রাথমিক ভাবে ফাইল ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, সব কিছু নিয়ম মেনেই হয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও দুর্নীতির সম্ভাবনা থাকতেই পারে। সাউথ ব্লকের এক কর্তার বক্তব্য, “প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাবেচার জগৎটাই রহস্যাবৃত। সেখানে অনেকেই মধ্যস্থতাকারীর কাজ করেন। কেউ নিজেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বা বায়ুসেনা-প্রধানের ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করে বরাত পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন। আবার কারও সঙ্গে বৈঠক করে দেওয়ার বিনিময়েও টাকা আয় করতে পারেন। সিবিআই ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-এর তদন্তে এই বিষয়টি উঠে আসবে।” বিজেপি-নেতা যশোবন্ত সিংহও একই যুক্তি দিচ্ছেন। এনডিএ আমলে জর্জ ফার্নান্ডেজের পদত্যাগের পর এক বছর প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। যশোবন্তের যুক্তি, ব্রজেশের নির্দেশ প্রযুক্তিগত ভাবে সঠিক ছিল। তদন্তের আগে প্রাক্তন বায়ুসেনা-প্রধান ত্যাগীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের জেরে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সিদ্ধান্ত, এই হেলিকপ্টার কেনার ক্ষেত্রে আর কোনও টাকা মেটানো হবে না। গোটা চুক্তিটাই স্থগিত রাখা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হল, ১২টি কপ্টারের মধ্যে তিনটি কপ্টার ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে। মার্চ মাসে আরও তিনটি এবং জুলাইতে বাকি ছ’টিও চলে আসার কথা। ১২টি কপ্টারের মোট দাম ৫৫৬ মিলিয়ন ইউরো, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩৬০০ কোটি টাকা। তার অর্ধেকটাই মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, যে টাকা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার কী হবে?
অ্যান্টনির যুক্তি, যে কোনও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার সময় ভারত সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে একটি সততা-রক্ষার চুক্তি করে। যেখানে বলেই দেওয়া হয়, লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনও ঘুষ বা কমিশন দেওয়া যাবে না। ঘুষ দেওয়ার প্রমাণ মিললে চুক্তি বাতিল হবে। সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। সর্বোপরি মোটা জরিমানা এবং ফৌজদারি মামলা হবে। কাজেই সরকারের কোনও টাকাই নষ্ট হবে না। কপ্টার-বাবদ দেওয়া পুরো অর্থই ফেরত পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.