প্রায়ান্ধকার সরু গলিতে ঢোকামাত্র একটা চেহারা ছিটকে সরে গেল। আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না! একটু এগোতে বাঁ দিকে চোখে পড়ল একটি ঘর। মোটাসোটা একটি লোক সেখানে বসে। অগত্যা তাঁকেই জিজ্ঞাসা করা গেল, মহম্মদ ইকবালের ঘর কোনটা? কিছু না-বলে আমার চোখের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। তার পরে বললেন, “বলতে পারব না। আমি এ-পাড়ায় থাকি না।”
গার্ডেনরিচের পাহাড়পুরে হরিমোহন ঘোষ কলেজে মঙ্গলবার যে-যুবক গুলি চালিয়েছিল বলে অভিযোগ, সেই শেখ সুহানের বাতিকলের বাড়িতে গিয়ে বুধবার যে-পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়েছিল, বৃহস্পতিবার যেন তারই প্রতিচ্ছবি দেখা গেল আয়রন সাইড রোডে মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার বাড়ির সামনে গিয়ে। বাড়ির চার পাশের মানুষগুলিকে কোনও এক অজানা ভয় তাড়া করে ফিরছে। অচেনা লোক দেখলেই সতর্ক হয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। আগন্তুক কোনও প্রশ্ন করলেই সটান বলে দিচ্ছেন, “এখানে থাকি না।”
শেখ সুহান রাজনৈতিক দলের সাধারণ সমর্থক, মাস্তান গোছের। মঙ্গলবারেই তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ফলে তার বাড়ি ঘিরে নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক কেন, সেটা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু মহম্মদ ইকবাল তো এলাকার বিরাট নেতা। এলাকার ঘরে ঘরে চর্চিত নাম! তিনি শাসক দল তৃণমূলের কাউন্সিলর, ১৫ নম্বর বোরো কমিটির চেয়ারম্যান।
তাঁকে ঘিরে নিরাপত্তাহীনতার এমন আতঙ্ক কেন? |
বন্দর এলাকায় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর ছেলেকে কেন বলতে হয়, “আমি ওঁর (ইকবাল) ছোট ছেলে। নাম জিজ্ঞাসা করবেন না।” অথচ তার কয়েক মিনিট আগেই গলির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ওই কিশোর বলেছিল, “মহম্মদ ইকবালের বাড়ি চিনি না। আপনারাই খুঁজে নিন।”
ইকবালের ছেলের সঙ্গে কথা বলার আগে গলির শেষ প্রান্তে এক মধ্যবয়সির সঙ্গে কথা বলব বলে এগিয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর শর্ত ছিল, “আগে ক্যামেরা বন্ধ করুন। তার পরে কথা হবে।” তিনিই ওই কিশোরকে দেখিয়ে দিলেন, “ও ইকবালের ছোট ছেলে। ওকেই জিজ্ঞাসা করুন।” কোথায় আছেন তোমার বাবা? ছেলের উত্তর, “বলতে পারব না। সকাল থেকে নেই।”
এলাকা বদলালেও মুদিয়ালির ছবিটাও একই রকম। ওখানেমোক্তারের বাড়ি। হরিমোহন কলেজের হাঙ্গামায় অন্যতম অভিযুক্ত তিনি। রয়েছেন কংগ্রেসের ছত্রচ্ছায়ায়।
ইকবাল ও মোক্তার দু’জনেই বন্দর এলাকা থেকে কার্যত বেপাত্তা। যদিও বুধবার বিকেল পর্যন্ত দু’জনকেই দেখা গিয়েছে এলাকায়। তাঁরা কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। টিভির পর্দাতেও তাঁদের সহাস্য মুখ দেখা গিয়েছে।
এ দিন বন্দর এলাকার জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে এলেও পুলিশি টহল ছিল চোখে পড়ার মতো। কলেজের সামনেও পুলিশ কার্যত জাল বিছিয়ে রেখেছে। স্থানীয় মানুষের ধারণা, এলাকায় পুলিশি তৎপরতা বাড়ায় বিবদমান দলের দুই নেতা কার্যত ফেরার। ইকবাল ও মোক্তার অবশ্য ফোনে সাড়া দিয়েছেন। ইকবালের দাবি, “আমি এলাকায় থাকলে গণ্ডগোল বাড়তে পারে বলেই দূরে আত্মীয়ের বাড়িতে রয়েছি।” আর মোক্তারের দাবি, “ব্যবসার কাজে বাইরে আছি।”
রাজনীতির কারবারিদের মতে, রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে পুলিশের হাত থেকে ছাড় পেয়েছিলেন ইকবাল। কিন্তু হাঙ্গামার দিন গুলিতে সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরীর মৃত্যুর পরে ইকবালকে গ্রেফতার করার জন্য চাপ আসতে শুরু করে পুলিশের মধ্য থেকেই। কারণ, তাপসবাবু যেখানে খুন হন, সেখানে দাঁড়িয়ে ইকবালই গণ্ডগোলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে পুলিশের খবর। টিভির পর্দাতেও তাঁকে দেখা গিয়েছে বারবার। তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর-ও করা হয়েছে।
পুলিশের একাংশের দাবি, উপর মহল থেকে মোক্তারকে আগে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে ধরার পরেই গ্রেফতার করা হত ইকবালকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশের পরে পুলিশ দু’জনকেই গ্রেফতার করতে তৎপর হয়েছে। পুলিশি সূত্রের খবর, গোয়েন্দা-বাহিনীর গুন্ডা দমন শাখার বাছাই অফিসারেরা বন্দর এলাকায় ঘুরছেন।
তৃণমূলের বোরো চেয়ারম্যানের এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পিছনে আরও একটি কারণের কথা বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের মতে, মঙ্গলবারের ঘটনার পরে এলাকায় নিজের কর্তৃত্ব অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন ইকবাল। মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে তাঁর খাসতালুক বলে পরিচিত এলাকার অনেকটাই নাকি চলে গিয়েছে মোক্তারের দখলে।
তা হলে কি প্রায়ান্ধকার ওই গলিতে এক দল সাংবাদিক দেখে ‘মোক্তারের লোক’ বলেই ভুল করেছিলেন কেউ কেউ?
|
ইকবাল-নামা উত্থান |
• দাদা মোগলের হাত ধরে অপরাধ জগতে হাতেখড়ি
• বছর দশেক আগে চোরাই ভোজ্য তেল-সহ গ্রেফতার
|
পতন |
• মোগল খুন হওয়ার পর মোক্তারের দাপটে কোণঠাসা
|
ফের উত্থান |
• তৃণমূল শক্তিশালী হতেই তাদের ঘনিষ্ঠ
• সমানে লড়াই মোক্তারের সঙ্গে
• ঠিকা শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ, পার্কিং লট নিয়ে বিবাদ
|
রাজনৈতিক আনুগত্য |
• আগের আমলে কংগ্রেস নেতা আনোয়ার টিডি
|
বর্তমানে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম |
সূত্র: কলকাতা পুলিশ |
|