বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মহাকরণে একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। কলকাতা পুলিশের কমিশনার পদ থেকে রঞ্জিত পচনন্দাকে সরানোর পরে এ বারে কি মুখ্যমন্ত্রীর কোপে পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ওরফে ববি? রাত পর্যন্ত প্রশ্নটা তাড়া করে গেল রাজ্যের মন্ত্রী থেকে আমলা, সব পক্ষকেই।
এ দিন পুলিশ কমিশনারের বদলিতে সিলমোহর দেওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ডাক পড়ে ফিরহাদের। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্য এবং আমলারা তখন আরও একটা বিস্ফোরণের অপেক্ষায়। তা অবশ্য হয়নি।
অতি ঘনিষ্ঠ ববি-কে কড়া ধমক দিয়েই মুখ্যমন্ত্রী এ যাত্রা ছেড়ে দিয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। মমতা-ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব এ ব্যাপারে খুবই কড়া। তবে ফিরহাদ ইস্তফা দেবেন, এখনও এমন পরিস্থিতি হয়নি।”
দলীয় সূত্রের খবর, দলের তরফে কলকাতা পুলিশ সংক্রান্ত বিষয়গুলি সামলাতেন ফিরহাদ। একই সঙ্গে বন্দর এলাকার দায়িত্বও ছিল তাঁর উপরে। কিন্তু গার্ডেনরিচের ঘটনায় সেই দুই দায়িত্বই ঠিক ভাবে পালন করতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ এই মন্ত্রী। মঙ্গলবার গুলিতে সাব-ইনস্পেক্টরের মৃত্যুর পরে তখনও কলকাতা না ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করে ফিরহাদই আশ্বাস দেন, ‘সব সামলে নেব।’ পুলিশের নিচুতলায় অসন্তোষের খবর পেয়ে মাঝপথ থেকে ফিরতে চেয়েছিলেন মমতা। কিন্তু তখনও ফিরহাদই তাঁকে জানান, কংগ্রেসের দুষ্কৃতী মোক্তারের দলবল গোটা ঘটনা ঘটিয়েছে। দলের কাউন্সিলর ও বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাকে বাঁচাতে গিয়েই এসআই তাপস চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। |
কিন্তু দলের অন্য সূত্রে এবং প্রশাসনিক কর্তাদের কাছ থেকে মমতা জানতে পারেন, ফিরহাদের দেওয়া তথ্য ঠিক নয়। বস্তুত তাঁর নির্দেশেই কলকাতা পুলিশ যে প্রথমে নিষ্ক্রিয় ছিল, তা-ও তৃণমূলের এক শীর্ষ মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। বিশেষ করে পুলিশ বুধবার আলিপুর আদালতে যে এফআইআরটি পেশ করে, তাতে গোটা ঘটনায় মহম্মদ ইকবালের ভূমিকা ম্পষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যেই মহাকরণে দাঁড়িয়ে বুধবার ফিরহাদ জানিয়ে দেন, ইকবাল যে গোটা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, তা তিনি মনে করেন না। পুরমন্ত্রীর এই মন্তব্য নিয়ে নানা মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বৃহস্পতিবার রাজ্যপালও ফিরহাদের এমন মন্তব্য নিয়ে কটাক্ষ করেন। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র পুলিশি তদন্তের উপরে অনাস্থা প্রকাশ করে সিবিআই তদন্তের দাবি জানান। আর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রতিটি ঘটনার রিপোর্ট পৌঁছে যায়।
এ দিন দিঘা থেকে ফেরার পথে মহাকরণে না গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে যান নিহত সাব ইনস্পেক্টরের বাড়িতে। তার পরেই মহাকরণে ফিরে পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দেন। এবং এই কাজ সেরে নিজের ঘরে ডেকে পাঠান ফিরহাদকে।
তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, যে সব কথা না বললেও চলত, সে সব কথা প্রকাশ্যে বলে ববি যে দল ও সরকারের মুখ পুড়িয়েছেন, তা স্পষ্ট হয়ে যায় পুরমন্ত্রীকে দেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর ধমকে। তৃণমূল সূত্রের খবর, মুন্নাকে নিয়ে প্রকাশ্যে বেফাঁস মন্তব্য করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ফিরহাদকে ভর্ৎসনা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, মন্ত্রী হয়েও সে দিনের ঘটনায় অভিযুক্ত ইকবালকে আড়াল করে ক্যামেরার সামনে যে ভাবে মন্তব্য করেছেন ফিরহাদ, তাতে রাজ্য সরকারই বিপাকে পড়েছে। রাজ্যপালও তা নিয়ে সমালোচনা করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন। ওই সূত্রের দাবি, ফিরহাদকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “তুই সরকারের মুখ পুড়িয়েছিস। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও ভাবে বলার কী দরকার ছিল?” দলের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, “একগাদা সাংবাদিক আর টিভি ক্যামেরার সামনে ববি যে ভাবে কথা বলেছে, তা মোটেই ঠিক নয়। ওর বোঝা উচিত ছিল, এ ধরনের ঘটনায় মন্ত্রী হিসেবে ওর বলা সব কথাই সংবাদমাধ্যম তুলে ধরবে আর তাতে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। অত কথা বলেই সরকারের সঙ্গে দলেরও মুখ পুড়িয়েছে ববি।”
মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখে পুরমন্ত্রী এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও তৃণমূলের অনেক নেতা-মন্ত্রীই এই ঘটনায় খুশি। তবে একই সঙ্গে তাঁদের মতে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে বলেই এক জন সংখ্যালঘু মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী যথেষ্ট কঠোর হতে পারলেন না। তৃণমূলের ওই সূত্রের অভিযোগ, কলকাতা পুরসভার ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে বলে দলে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাদ সেধেছেন ফিরহাদই। ওই সূত্রের দাবি, তাঁর ছত্রছায়ায় থাকা ইকবালকে বুধবার রাতেই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন পুরমন্ত্রী। ফিরহাদের ঘনিষ্ঠ সূত্র অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দলীয় সূত্রের খবর, এত দিন দলের তরফে কলকাতা পুলিশ দেখতেন ফিরহাদ। আর রাজ্য পুলিশ সংক্রান্ত দায়িত্বে ছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। এ দিনের ঘটনার পরে সেই সমীকরণ বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। হয়তো মুকুলবাবুকেই রাজ্যের পাশাপাশি কলকাতা পুলিশ সংক্রান্ত বিষয়ও দেখতে নির্দেশ দিয়ে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। দলীয় সূত্রের আরও খবর, বন্দর এলাকায় ফিরহাদের ডানা ছেঁটে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
তৃণমূলের একাংশ চাইছে, মুন্নাকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে কিছুটা হলেও ভাবমূর্তি রক্ষার ব্যবস্থা হোক। দলের একাংশ এমনও মনে করছে, মুন্না এবং মোক্তার, দু’জনকেই গ্রেফতার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হোক। তদন্তভার সিআইডি’র হাতে গেলেও মুন্নাকে গ্রেফতারির ব্যাপারে প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে পুরোপুরি সবুজ সঙ্কেত এখনও মেলেনি বলে শাসক দলের একটি সূত্রের খবর। মন্ত্রিসভার এক সদস্যের কথায়, “শুধু মুন্না বা মোক্তার নয়, এই ঘটনাকে সামনে রেখে গার্ডেনরিচ-মেটিয়াব্রুজের গোটা এলাকাকে সমাজবিরোধী এবং অস্ত্রমুক্ত করতে পারলে জনমানসে এখনও ভাল বার্তা যেতে পারে।” বাস্তবে তেমন ঘটবে কি না, তা অবশ্য তৃণমূল নেতৃত্বের কেউ হলফ করে বলতে পারছেন না!
মহাকরণে রাজ্য মন্ত্রিসভার সব থেকে সরব মন্ত্রীর নাম ফিরহাদ হাকিম। সরকারের ‘মুখপাত্র’ হিসেবে যে কোনও বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঢাল হিসাবে মুখ খোলেন তিনি। গার্ডেনরিচের ঘটনার পরেও তাঁকে সেই ভূমিকাতেই দেখা গিয়েছে। কিন্তু এ দিন সকাল থেকেই সুর কাটতে থাকে। পরিস্থিতি অনুকূল নয় বুঝে নিজেকে গুটিয়ে নেন পুরমন্ত্রী। মহাকরণে প্রায় সব প্রশ্নের উত্তরেই তিনি চুপ। মহাকরণ থেকে সল্টলেকের সরস মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যান তিনি। মঞ্চে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, শান্তিরাম মাহাতো প্রমুখ থাকলেও পুরমন্ত্রী ঢুকতেই শুরু হয় জল্পনা। পুরমন্ত্রী অবশ্য নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। কিন্তু গার্ডেনরিচের ঘটনা নিয়ে তৈরি হওয়া ঘরে-বাইরের চাপে তিনি যে স্বস্তিতে নেই, তা তাঁর শরীরী ভাষায় পরিষ্কার। একবারই মুখ খোলেন তিনি। যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, গার্ডেনরিচ-কাণ্ড নিয়ে গত দু’দিনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কোনও কথা হয়েছে কি? ফিরহাদের উত্তর, “না, কোনও কথা হয়নি।” |