নিচুতলার মনোবল দু’দিন আগেই চুরমার হয়েছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধেয় কলকাতা পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে রঞ্জিতকুমার পচনন্দার অপসারণে হতাশা ছড়িয়ে পড়ল পুলিশের অন্যান্য স্তরেও। কলকাতার একটি ডিভিশনের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্তা বিহ্বল হয়ে বলে ফেললেন, “আগ বাড়িয়ে কাজ করলেও বিপদ, সাবধানী হলেও নিস্তার নেই। কেন যে পুলিশ কমিশনারকে সরানো হল, বুঝতেই পারছি না।”
গার্ডেনরিচে দুষ্কৃতীর গুলিতে কলকাতা পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর খুন হওয়ার পরে অভিযুক্তদের ধরেও প্রথমে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় স্থানীয় পুলিশ। তাতে চাপা ক্ষোভে ফুঁসছিল পুলিশ বাহিনীর বড় অংশ। অবস্থা বুঝে দেরিতে হলেও ‘ড্যামেজ-কন্ট্রোল’ করতে নামেন পচনন্দা। গার্ডেনরিচ থানায় বসে থেকে তিনি শেখ সুহান আর ইবনেকে গ্রেফতার করিয়েছিলেন। বুধবার সকাল থেকে অন্য দুই অভিযুক্ত মোক্তার এবং ইকবালকে ধরার জন্য ঝাঁপিয়েছিল কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। সেই অভিযানের মধ্যেই খবর আসে পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্যের পুলিশ-কর্তাদের একাংশের মতে, শাসক দলের রাজনৈতিক চাপের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে গিয়েই সরতে হল পচনন্দাকে। রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও পুলিশ কমিশনারকে অপসারণের এই সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। প্রাক্তন গোয়েন্দা-কর্তা নারায়ণন এ দিন বলেন, ‘‘যদি গত কয়েক দিনের ঘটনার জেরে তাঁকে সরানো হয়ে থাকে, তবে তা খতিয়ে দেখতে হবে। মনে হচ্ছে, কোথাও ভুল হয়েছে।”
এ দিন সন্ধেবেলাই পচনন্দার স্থলাভিষিক্ত হন সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। তিনি আগে এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) ছিলেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে কিছু বলার নেই। সরকারের তরফে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আইনগত ভাবে তা পালন করা হবে। সকলের সহযোগিতা আশা করছি।” কিন্তু এই ঘটনায় পুলিশ মহলের মনোবল যে ভাবে ধূলিসাৎ হল, তা কী ভাবে মেরামত করা যাবে, তা নিয়ে সন্দিগ্ধ পুলিশেরই একাংশ। এ ভাবে আচমকা পুলিশ কমিশনার বদলে বাহিনীর মনোবল তো বাড়বেই না, উপরন্তু কমবে এমনটাই মনে করছেন পুলিশ-কর্তাদের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, দেরিতে হলেও সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন রঞ্জিতকুমার পচনন্দা। তাঁর নির্দেশেই পুলিশ গ্রেফতার করে অভিযুক্তদের। তার পরেও তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার প্রভাব বাহিনীর উপরে পড়বেই। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার মন্তব্য, “যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, তাতে নতুন পুলিশ কমিশনারকে আরও চাপের মুখে কাজ করতে হবে। কারণ আমরা কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক, সেটাই বুঝতে পারছি না।”
গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে লালবাজারের প্রাথমিক ঢিলেমির জন্য প্রথমে কিন্তু পচনন্দাকেই দায়ী করেছিলেন প্রাক্তন পুলিশ কর্তাদের অনেকে। তার মধ্যে এক জন কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়। এ দিন রঞ্জিতকুমার পচনন্দার হঠাৎ অপসারণে বিস্মিত তিনিও। তাঁর মন্তব্য, “গার্ডেনরিচের ঘটনায় প্রথমে পচনন্দা নেতার পরিচয় দিতে পারেননি। তার পরে পুলিশ অবশ্য অভিযানে নেমেছিল। এখন কেন পচনন্দাকে সরানো হল, বুঝতে পারছি না।”
শুধু পচনন্দাকে সরানো নয়, এ দিন এসআই খুনের ঘটনার তদন্তভারও লালবাজারের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতা পুলিশের এলাকায় আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যার তদন্তে লালবাজারের উপর আস্থা না রেখে অন্য কাউকে তদন্তের ভার দেওয়ার এমন ঘটনা বেনজির। লালবাজারের এক আইপিএস অফিসারের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, “নানা চাপ কাটিয়ে আমরা তো শেষ পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের কাজে তো গাফিলতি ছিল না। তা হলে কেন এই সিদ্ধান্ত?”
কলকাতা পুরসভার বরো চেয়ারম্যান ও তৃণমূল নেতা মহম্মদ ইকবালকে পাকড়াও করতে এ দিন বিকেল থেকেই অভিযান শুরু করেছিলেন গার্ডেনরিচ থানা ও গোয়েন্দা বিভাগের গুন্ডাদমন শাখার অফিসারেরা। ঠিক সেই সময়ই তাঁদের কাছে খবর যায়, তদন্তভার কলকাতা পুলিশের হাত থেকে চলে গিয়েছে সিআইডি-র হাতে। এটা শোনার পর থেকেই কার্যত মুষড়ে পড়েন কলকাতা পুলিশের অফিসারেরা। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, “সহকর্মীর খুনের তদন্ত করার মধ্যে একটা অন্য জেদ ছিল। কেন আমাদের উপরে ভরসা রাখা হল না, মাথায় ঢুকছে না।” আর এক গোয়েন্দা-কর্তার আক্ষেপ, “এত জনকে গ্রেফতার করলাম। আর ইকবালকে ধরতে পারতাম না?!”
এর আগে মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানের বিরোধিতা করে তদন্ত চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জেরে দময়ন্তী সেনকেও লালবাজার থেকে সরতে হয়েছিল। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ মামলায় মুখ্যমন্ত্রী ‘সাজানো ঘটনা’ বলার পরেও তৎকালীন গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেন তদন্তে আপস করেননি। প্রকৃত অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে দময়ন্তীর নেতৃত্বেই তাদের গ্রেফতার করে লালবাজারের গোয়েন্দা-বিভাগ। সেই সময়ে অবশ্য পচনন্দার ভূমিকাতেও পুলিশ-মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তখন মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাজানো ঘটনা’-র তত্ত্বে সুর মিলিয়ে পচনন্দাও বলেছিলেন, “সংবাদমাধ্যমের একাংশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে।” এ বার কিন্তু শাসক দলের কোপে দময়ন্তী (বর্তমানে ডিআইজি দার্জিলিং) এবং পচনন্দা (নবনিযুক্ত নিরাপত্তা অধিকর্তা) দু’জনেই এক বন্ধনীভুক্ত হলেন বলেই মন্তব্য করছেন রাজ্যের পোড় খাওয়া পুলিশ-কর্তারা।
|
বদলি-বিশদ |
কে |
ছিলেন |
হলেন |
সুরজিৎ করপুরকায়স্থ |
অতিরিক্ত ডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) |
পুলিশ কমিশনার |
রঞ্জিতকুমার পচনন্দা |
পুলিশ কমিশনার ডিরেক্টর |
সিকিউরিটি ও মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা |
বাণীব্রত বসু |
অতিরিক্ত ডিজি (আইবি) |
অতিরিক্ত ডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) |
জিএমপি রেড্ডি |
অতিরিক্ত ডিজি (প্রশাসন) |
অতিরিক্ত ডিজি (আইবি) |
বীরেন্দ্র |
ডিরেক্টর সিকিউরিটি |
অতিরিক্ত ডিজি (প্রশাসন) |
সৌমেন মিত্র |
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার |
আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) |
|