|
|
|
|
গাড়িতেই সিদ্ধান্ত, দিঘা থেকে সোজা ঠাকুরপুকুর |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
প্রতীক্ষার অবসান হল একান্ন ঘণ্টা বাদে। সদ্য স্বামীহারা মিনতি চৌধুরীর বাড়িতে পা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মঙ্গলবার দুপুরে গার্ডেনরিচে কলকাতা পুলিশের এসআই তাপস চৌধুরী গুলিতে মারা যাওয়ার পর থেকে তাঁর স্ত্রী মিনতিদেবী অপেক্ষা করছিলেন, কখন মুখ্যমন্ত্রী এক বার এসে পাশে দাঁড়াবেন। শেষমেশ বৃহস্পতিবার বিকেলে, দিঘা থেকে ফেরার পথে মমতা তাঁর কাছে গেলেন। তাপসবাবুর পরিবারের জন্য নানা আর্থিক সহায়তাও ঘোষণা করলেন। যা নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধতেও দেরি হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর ‘দানছত্র’ রাজনীতির সমালোচনা করে বিরোধীরা বলছেন, এ ভাবে রাজধর্ম পালন হয় না।
তাপসবাবুর মৃত্যুর পরে ঘটনাটি সম্পর্কে মমতা কার্যত কোনও বিবৃতি দেননি। বরং সরকারের তরফে পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানিয়ে দিয়েছিলেন, সিপিএম ও কংগ্রেসের দুষ্কৃতীরা তাপসবাবুকে খুন করেছে। তার পরে সে দিন বেলা যতই গড়িয়েছে, টিভি’র পর্দায় মানুষ বার বার দেখেছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা ইকবাল ওরফে মুন্নার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্কৃতীর গুলিতে তাপসবাবুর লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য। পুলিশ পরে ওই যুবক ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেফতার করলেও এফআইআরে নাম থাকা ইকবালকে ধরা হয়নি। এবং তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পরেও মুখ্যমন্ত্রীর কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। উল্টে নন্দীগ্রামে গানের তালে হাততালি দিয়ে আরও সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি। ঘটনার পর দিনও তিনি দিঘার সৈকতে কাটিয়েছেন। আর এরই মধ্যে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের প্রবল চাপে বুধবার তাপসবাবুর বাড়িতে গিয়েছেন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা। বলে এসেছেন তাপসবাবুর মেয়ে তনুশ্রীকে পুলিশে চাকরি দেওয়ার কথা। |
শেষের সে দিন: তখনও জানেন না, মৃত্যু আর কয়েক মুহূর্ত দূরেই।
গার্ডেনরিচে তাপস চৌধুরীর ছবিটি তুলেছিলেন শুভাশিস ভট্টাচার্য। |
বৃহস্পতিবারে ঘটনাক্রম কিছুটা অন্য দিকে মোড় নিয়ে নেয়। এ দিন সকালে মুখ্যমন্ত্রীর দিঘা থেকে সোজা মহাকরণে ফেরার কথা ছিল। এ দিকে বেলা সওয়া একটায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মিনতিদেবীর বাড়িতে যান। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর আসা উচিত ছিল। খবর নিয়ে দেখেছি, তিনি দিঘার সৈকতে ঘুরছিলেন। পর্যটনকেন্দ্রের জায়গা ঠিক করছিলেন। এটা ওঁর কাজ নয়।”
এর পরে যান রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন, বেলা পৌনে দু’টো নাগাদ। ঘরে ঢুকতেই তাপসবাবুর ছেলে তমাল কেঁদে বলে ওঠে, “আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন।” শুনে রাজ্যপাল বেশ কিছুক্ষণ নিরুত্তর থাকেন। পরে বলেন, “সংবাদমাধ্যম থেকে সবই জেনেছি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।” মিনতিদেবীর মুখে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তার কথা শুনে রাজ্যপালের আশ্বাস, এ ব্যাপারে তিনি সরকারের সঙ্গে কথা বলবেন। বেলা দু’টোয় বেরিয়ে রাজ্যপাল বলেন, “রাজ্য সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় আরও যত্নবান হওয়া উচিত, এফআইআরে নাম-থাকা প্রত্যেককে গ্রেফতার করা উচিত।” ফিরহাদ হাকিম অভিযুক্ত ইকবালকে আড়াল করছেন কি না, সে প্রশ্নের জবাবে রাজ্যপালের মন্তব্য, “ফিরহাদ এমন করে থাকলে সেটা তাঁর কাজ নয়। আমি বিষয়টাকে এ ভাবেই দেখি।”
প্রথমে বিরোধী দলনেতা, পরে রাজ্যপালের যাওয়া ও তাঁর মুখে সরকারের সমালোচনায় মুখ্যমন্ত্রীর উপরে চাপ তৈরি হয়। প্রশাসন-সূত্রে খবর, রাজ্যপাল নিজে মিনতিদেবীর কাছে চলে যাবেন, এটা মুখ্যমন্ত্রী আঁচ করতে পারেননি। বস্তুত এমন কোনও ঘটনায় রাজ্যপাল কারও বাড়ি গিয়েছেন, সেই দৃষ্টান্তও কার্যত নেই। নন্দীগ্রামের গুলিচালনার পরে তদানীন্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী সরকারের কড়া সমালোচনা
করে তমলুক হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন। তবে নিহত কারও বাড়িতে যাননি।
পরিস্থিতি অনুধাবন করে মমতা এ দিন গাড়িতে বসেই সিদ্ধান্ত নেন, ঠাকুরপুকুরে যাবেন। প্রশাসনিক-সূত্রের খবর: মুখ্যমন্ত্রী মিনতিদেবীর বাড়িতে গিয়ে যে সব সাহায্যের কথা ঘোষণা করবেন, তারও ফাইলও দ্রুত তৈরি হয়ে যায়। বেলা সাড়ে তিনটেয় মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় ঢুকে পড়ে তাপসবাবুর বাড়ির গলিতে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুকুল রায় ও সচিব গৌতম সান্যাল। দরজার মুখে টেবিলে বসানো তাপসবাবুর ছবিকে প্রণাম করে, চটি খুলে মমতা ঘরে ঢোকেন। বাটিক প্রিন্টের চাদর গায়ে মিনতিদেবী খাটে বসেছিলেন, পাশে ছেলে-মেয়ে। কিছু আত্মীয়ও ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে তমালকে জড়িয়ে ধরেন। তাপসবাবুর দাদা দেবদাসবাবু সকলের পরিচয় দিতে গেলে তিনি বলে ওঠেন, “ওদের পরিচয় দিতে হবে না। আমি সবাইকে চিনি। তাপসকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে অনেক দিন আগে থেকেই চিনি।”
|
বিকেলে তাপস চৌধুরীর বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী। তার আগে, সকালেই ঘুরে গিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। |
|
|
সূর্যকান্ত মিশ্র
|
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
|
• ফিরহাদের ভূমিকা তিনি যে দোষীকে আড়াল
করছেন এবং
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তা
বিশ্বাস করার
যথেষ্ট কারণ আছে।
• ইকবালকে গ্রেফতার ওকে ফিরহাদ আড়াল
করছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী) পর্যটন
দেখছেন,
আর ফিরহাদ দেখছেন স্বরাষ্ট্র।
• পুলিশি তদন্ত রাজ্যের মন্ত্রী এই ঘটনায়
জড়িত থাকায় আমরা সিবিআই তদন্ত চাই। |
• গার্ডেনরিচের গুলিচালনা আইন আইনের
পথে চলবে। আমার এক লাইনই যথেষ্ট।
• ইকবালকে গ্রেফতার ২৪ ঘণ্টা,
এবিপি আনন্দকে
কিছু বলতে আসিনি। ডোন্ট
প্রিপেয়ার এনি প্ল্যান।
(একটু থেমে) আরও
অনেকের বিরুদ্ধে
এফআইআর
হয়নি কেন, সেটাও খোঁজ নেব। |
|
আর এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি তনুশ্রীকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন। তাপসবাবুর বৃদ্ধা মা ও অবিবাহিত বোনের জন্য আর্থিক সাহায্যের কথা বলেন। জানান, তমাল পরে উচ্চশিক্ষায় যেতে চাইলে দায়িত্ব সরকারের। তাঁর নির্দেশে সচিব গাড়ি থেকে দু’টো ফাইল নিয়ে আসেন। ফাইলের কাগজপত্র মুখ্যমন্ত্রী মিনতিদেবীদের দেখান। বেরোনোর সময়ে তনুশ্রীকে এ-ও বলেন, “চিন্তা কোরো না। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি যাতে হয়, তার ব্যবস্থা নেব।” তনুশ্রীর মামা মধুসূদন চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা, দোষীদের সত্যিই শাস্তি হবে তো? মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, “অবশ্যই। যার যা শাস্তি পাওয়া উচিত, তারা তা-ই পাবে।’’ তাপসবাবুর অম্ত্যেষ্টিতে উপস্থিত থাকতে মমতাকে অনুরোধ করেন তনুশ্রী।
মিনিট সাতেক বাদে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। বলেন, “নন্দীগ্রামে যেতে যেতে আমি ঘটনার খবরটা পেয়েছিলাম। যিনি মারা গিয়েছেন, তিনি ব্যক্তিগত ভাবে আমার পরিচিত ছিলেন। পরিবারটিকেও চিনি।” তাপসবাবুর মৃত্যুকে নিজের ব্যক্তিগত ক্ষতি বলে বর্ণনা করেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী চলে যাওয়ার ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে, সন্ধ্যায় তনুশ্রীর চাকরির সরকারি বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়ে যায়। তনুশ্রী জানান, পুলিশের কিছু আধিকারিক এসে তাঁর চাকরির পাকা খবর শুনিয়ে গিয়েছেন। সোমবার তাঁকে চাকরিতে যোগ দিতে বলা হয়েছে। রাতে মহাকরণ ছাড়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তনুশ্রীর পড়াশোনা যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য তিনিসে অফিসে যখন খুশি আসতে-যেতে পারবেন।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই সব ঘোষণাকে আদৌ রাজধর্ম পালন হিসেবে
দেখছে না বিরোধীরা। সিপিএম
রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর মহম্মদ সেলিমের কথায়, “এই সময়ে মানুষ প্রশাসককে দেখতে চেয়েছিল। প্রশাসন কোথায়? দানছত্র করাকে রাজধর্ম বলে না!” সেলিমের প্রশ্ন, “মানুষ জানতে চায়, ওঁরই মন্ত্রিসভার সহকর্মী এবং দলের নেতারা যে ভাবে তদন্তকে প্রভাবিত করছেন, সে সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য কী? টাকা দেওয়ার ঘোষণাই কি মুখ্য প্রশাসকের একমাত্র কাজ?” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “একে রাজধর্ম বলে না। উনি কিছু ত্রাণ দিয়ে এসেছেন। মন্ত্রীরা অপরাধীদের আড়াল করছেন। সে সব বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপ এখনও চোখে পড়েনি।” পিডিএসের রাজ্য সম্পাদক সমীর পূততুণ্ডের দাবি, “রাজ্যপালের মন্তব্যের পরে পুরমন্ত্রীর হয় পদত্যাগ করা উচিত, নয়তো মুখ্যমন্ত্রীর উচিত ওঁকে সরিয়ে দেওয়া।” |
প্রতিশ্রুতি
|
স্ত্রীর জন্য
• অবসর (২০১৭ সাল) পর্যন্ত স্বামীর পুরো বেতন
(বেতন বৃদ্ধি এবং পদোন্নতির প্রাপ্য সমেত) |
মেয়ের জন্য
• পুলিশ বিভাগে করণিকের চাকরি
(মা চেয়েছিলেন, মেয়েকে যাতে পথে কাজ করতে না হয়) |
ছেলের জন্য
• পড়াশুনার যাবতীয় খরচ, পরে উচ্চশিক্ষার খরচও |
বৃদ্ধা মা ও অবিবাহিতা বোনের জন্য
• মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৫ লক্ষ টাকা |
গোটা পরিবারের জন্য
• দুর্ঘটনা বিমার ১৫ লক্ষ
• সরকারের তরফে আরও ৫ লক্ষ |
|
—নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|