পরিবর্তন, এ বার পচনন্দা
থার্থ অধিনায়ক হয়ে ওঠার চেষ্টার ৪৮ ঘণ্টা পেরোতে না-পেরোতেই সরতে হল পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দাকে। নতুন কমিশনার হলেন রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। সেই সঙ্গেই গার্ডেনরিচে পুলিশ খুনের ঘটনার তদন্তভার কলকাতা পুলিশের হাত থেকে কেড়ে দেওয়া হল সিআইডি-কে। যা কার্যত নজিরবিহীন।
কেন পচনন্দার অপসারণ?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “সমাজবিরোধী, যাদের নামে এফআইআর আছে, তাদের সবাইকে আগেই ধরা উচিত ছিল। কেন দোষীদের গ্রেফতার করা হল না? ‘অ্যাকশন’ নিতে দেরি হয়েছে। তাই আমাকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হল।”
রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই মনোভাবের সঙ্গে একমত নন। বরং অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি জানান, “যদি গত ক’দিনের ঘটনার জেরে তাঁকে সরানো হয়ে থাকে, তবে তা খতিয়ে দেখতে হবে। মনে হচ্ছে, কোথাও ভুল হয়েছে।”

বিদায় পচনন্দা। পিছনে নতুন পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ। ছবি: সুদীপ আচার্য।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ‘দেরি’র প্রসঙ্গ তুলে মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেন, “৫২ ঘণ্টা দেরি তো উনি নিজেই করেছেন। দেরিতে কাজ করার যুক্তি তা হলে ধোপে টেকে না।” পচনন্দাকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে পুলিশের মনোবল যে ফের তলানিতে গিয়ে ঠেকবে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সূর্যবাবু বলেন, “এই ব্যাপারে ওঁর (মমতার) বক্তব্য কী?”
মনোবলের বিষয়টি এ দিন কলকাতা পুলিশের বিভিন্ন মহলে ঘুরে ফিরে এসেছে। ‘পুলিশ’ হয়ে ওঠার পরে যে ভাবে পচনন্দাকে সরতে হল, সেই খবরে এক পুলিশকর্তা বলেই ফেললেন, “আগ বাড়িয়ে কাজ করলেও বিপদ। সাবধানী হলেও নিস্তার নেই। কেন যে পুলিশ কমিশনারকে সরানো হল, বুঝতেই পারছি না!”
কী করেছিলেন পচনন্দা?
দুষ্কৃতীর গুলিতে তাঁর বাহিনীর এক কর্তব্যরত অফিসার দিনেদুপুরে খোলা রাজপথে অনেক মানুষের চোখের সামনে মারা যান। তার পরে এক অভিযুক্তকে হাতে পেয়েও রাজনৈতিক চাপে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। এই পরিস্থিতিতে পুলিশের নিচুতলায় প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়। বিক্ষোভের মুখে পড়ে তার আঁচ কিছুটা পান পচনন্দা। তিনি বুঝতে পারেন, ‘পুলিশধর্ম’ পালনের সময় এসেছে। তাই বাহিনীর মনোবল ফেরাতে নিজে গার্ডেনরিচ থানায় গিয়ে ওসি-র চেয়ারে বসে অধস্তন অফিসারদের নির্দেশ দেন, “দুষ্কৃতীদের আমার এখনই চাই। আমি বসে আছি, আপনারা ধরে আনুন।”
এম কে নারায়ণন
রাজ্যপাল
• আপনি কি জানেন গার্ডেনরিচ কাণ্ডের জেরে সিপি-কে সরানো হয়েছে?
যদি গত ক’দিনের ঘটনার জেরে তাঁকে সরানো হয়ে থাকে, তবে তা খতিয়ে দেখতে হবে। মনে হচ্ছে, কোথাও ভুল হয়েছে।

• এই দলের সরকার চালানোর ক্ষমতা আছে বলে মনে হয়?
শাসক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এসেছে। তাদেরই প্রমাণ করতে হবে, সরকার চালাতে পারবে কি না।
এখানেই শেষ নয়। বুধবার পচনন্দা যান নিহত সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরীর বাড়ি। সেখানে তাপসবাবুর স্ত্রী মিনতিদেবীর হাতে দু’লক্ষ টাকা তুলে দিয়ে তিনি বলেন, “সরকার থেকে নয়। এটা পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া হল।”
কলকাতা পুলিশের নিচুতলায় এই দুই ঘটনা ম্যাজিকের মতো কাজ করে। কঠোর পুলিশ অফিসার এবং সহানুভূতিশীল সহকর্মী, দুই ভূমিকায় পচনন্দা নিচুতলার কাছে পৌঁছে যান। তাঁর নির্দেশের অল্পক্ষণের মধ্যেই সুহান, ইবনে-সহ দুষ্কৃতীরা পরপর ধরা পড়তে থাকে। রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর অতি-ঘনিষ্ঠ ফিরহাদ হাকিম স্থানীয় যে তৃণমূল নেতাকে ‘আড়াল’ করার চেষ্টা করেছেন, সেই মহম্মদ ইকবালের বিরুদ্ধেও এফআইআর করা হয়। এফআইআর হয় এলাকার কংগ্রেস নেতা মোক্তারের নামেও। কিন্তু পুলিশের অন্দরে খবর, মন্ত্রিমহলের ‘চাপে’ ইকবালকে দু’দিনের মধ্যেও ধরা যায়নি। ধরা হয়নি মোক্তারকেও। কমিশনারের ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে খবর, গার্ডেনরিচে তদন্তের ক্ষেত্রে ওই প্রভাবশালী মন্ত্রী যে এক এক বার এক এক রকম নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা তিনি মুখ্যমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার বিকেলে দিঘা থেকে কলকাতায় ফিরে এসে মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু পুলিশের দিকেই আঙুল তোলেন। বলেন, “সমাজবিরোধী, যাদের নামে এফআইআর আছে, তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা উচিত ছিল। আমি চাই দুষ্কৃতীরা গ্রেফতার হোক। পৃথিবীর যে প্রান্তেই ওরা থাকুক, গ্রেফতার করা উচিত ছিল।”
এর পর পচনন্দার অপসারণ ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। মহাকরণে তাঁর ঘরে দফায়-দফায় বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। ডাক পড়ে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব ও সুরজিৎ করপুরকায়স্থের। সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত ঘোষণা।
পচনন্দা অবশ্য দুপুরেই বার্তা পেয়ে যান, এ বার তাঁকে সরতে হবে। দুপুরেই স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে এই ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে দেন। পরে সরকারি ঘোষণা করে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র বলেন, রাজ্য এবং বিশেষ করে কলকাতা শহরের আইনশৃঙ্খলার স্বার্থেই এই বদলি। গত কয়েক দিন ধরে মহানগরে কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে বদলি করা হয়েছে। তবে সরকারি চাকরিতে বদলি বদলি-ই। এর মধ্যে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক বলে কিছু হয় না। এবং সমস্ত পদ্ধতি মেনেই এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে।
দুই অপসারণ
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ১৭ অক্টোবর, ২০০৭

গার্ডেনরিচে দুষ্কৃতীর গুলিতে
পুলিশ খুনের জেরে
সরস্বতী পুজোর
(বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে)
দিনে রঞ্জিতকুমার
পচনন্দার অপসারণ।

‘‘এফআইআরে অনেকের
নাম আছে, তাদের আগেই
ধরা উচিত ছিল। অ্যাকশন
নিতে দেরি হয়েছে। তাই আমাকে
কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হল।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর জেরে পুজোর
ষষ্ঠীর বিকেলে সরতে হয় প্রসূন মুখোপাধ্যায়কে।

‘‘দুর্বল হলে কি আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম!’’
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
বদলি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি পচনন্দা। নতুন কমিশনারের হাতে কার্যভার দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথে সহকর্মীদের শুধু বলেছেন, “থ্যাঙ্ক ইউ। অল দ্য বেস্ট।” তবে ঘনিষ্ঠমহলে তিনি বলেন, সরিয়ে দেওয়া হলেও তাঁর আক্ষেপ নেই। কারণ, তাঁর বাহিনী মার খাবে আর তিনি ‘দাঁড়িয়ে দেখবেন’, এটা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন। পচনন্দার এই ব্যাখ্যা অবশ্য মানতে চাইছে না সরকার পক্ষ। তাদের বক্তব্য, পুলিশ হয়ে উঠতে গিয়ে পচনন্দা তৃণমূলের লোকেদেরই ধরেছেন। যদিও কমিশনারের বক্তব্য ছিল, ঘটনায় প্রকৃত অর্থে যারা জড়িত, তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে। প্রশাসনের একাংশ বলছে, এতে মুখ্যমন্ত্রীর গোঁসা আরও বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত পদ খুইয়েই তার মাসুল দিতে হল পচনন্দাকে।
২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে নির্বাচন কমিশন পচনন্দাকে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের পদে বসিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতার সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে তাঁর সম্পর্ক যে খুব সহজ ছিল, তা নয়। তখন রাজ্যপালই মমতাকে বোঝান, আপাতত পচনন্দাকে রেখে দিন। পরে তাঁকে বদলির কথা ভাববেন। এর পরে বেদিভবনের ঘটনায় মমতা-পচনন্দার ব্যক্তিগত বিরোধের জায়গা তৈরি হয়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, শিবাজি ঘোষকে স্পেশ্যাল সিপি করে লালবাজারে নিয়ে আসা হয়। জল্পনা শুরু হয়, তিনিই হচ্ছেন পরের কমিশনার। কিন্তু ধীরে ধীরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ চালানোর মতো সমীকরণ তৈরি করেন পচনন্দা। শেষ কালীপুজোয় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির প্যান্ডেলে পুলিশের পোশাক পরে খালি পায়ে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। মমতা পুরনো কথা মনে না করে তাঁকে নিয়েই বেশ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। খুশি ছিলেন পচনন্দাও। কিন্তু গার্ডেনরিচের ঘটনার পর ‘পুলিশ’ হয়ে উঠতে গিয়েই তাঁকে পদ খোয়াতে হল।
পুলিশের একাংশ অবশ্য বলছে, কমিশনারের পদ থেকে সরালেও পচনন্দাকে ছুড়ে ফেলে দেননি মমতা। তাঁকে ডিরেক্টর অফ সিকিউরিটি করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা, তাঁদের মাথায় বসানো হল পচনন্দাকে। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলয়ের কাছাকাছি থাকা এবং সেই বলয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সুযোগ রয়ে গেল তাঁর।
শঙ্খ ঘোষ
আমাদের আজ গ্রাস করেছে ভয়াবহতা। মনে পড়ে তাঁদের কথা, যাঁরা চিন্তা দিয়ে কাজ দিয়ে প্রতিরোধ চেতনা জাগিয়ে রাখেন অনুক্ষণ।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.