তারাবাজি
রূপে সরস্বতী গুণে সরস্বতী
দুই নারী। না, হাতে তরবারি নেই। হাতে তানপুরা। সামনে মাইক্রোফোন।একজন কৌশিকী চক্রবর্তী। বয়স ৩২। ট্যুইটার অ্যাকাউন্টে নিজের পরিচয় লিখেছেন: “গান গাইতে ভালবাসি। আর একজন গর্বিত মা... এটুকুই আপাতত... কলকাতা, ভারত।” আর একজন শ্রেয়া ঘোষাল। বয়স ২৮। ট্যুইটার অ্যাকাউন্টে নিজের পরিচয় দেন: “আ ফ্লাওয়ার চাইল্ড। প্রেমের সুরে গান গাই।”একবাক্যে বলতে গেলে দু’জনেই গুণে সরস্বতী। তাঁদের রূপের ভক্ত অনেকে। সিনেমায় অভিনয় করার অফারও পেয়েছেন অনেক। তবে পাকাপাকি ভাবে অভিনয় করতে দু’জনেই নারাজ। গানই তাঁদের জীবন।
সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্র ইতিমধ্যেই শুরু করে ফেলেছেন একটি অ্যালবামের পরিকল্পনা। সেপ্টেম্বর নাগাদ হয়তো মুক্তি পাবে সেটি।
এই প্রথম বার শ্রেয়া আর কৌশিকী একসঙ্গে গাইবেন সেখানে। সারা ভারত জুড়ে কনসার্টও করবেন দু’জনে।
তবু ছিদ্রান্বেষীরা বলছেন দু’জনের মধ্যে না কি তলে তলে বেশ রেষারেষি। কেউ বলছেন না শ্রেয়া কৌশিকীর মতো মার্গীয় সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। সেখানে সব্বাই একমত যে কৌশিকী যে জায়গাতে আছেন, সেখানে ওঁর সমসাময়িক কোনও মহিলা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীর হয়তো নেই। তবে কোক স্টুডিওতে কৌশিকীর ‘লগি লগি’ গানটা হিট হওয়ার পরে অনেকেরই ধারণা যে তিনি শ্রেয়ার মতো ‘চিকনি চামেলি’ ধাঁচের গানও গাইবেন! মুম্বইতেও নাকি শিফ্ট করবেন।
কৌশিকী অবশ্য প্রথমেই ধুর ছাই বলে উড়িয়ে দেন সব গুজবকে। “ছেলেকে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করছি। মুম্বইতে শিফ্ট করতে যাব কেন? শ্রেয়া আর আমি ভীষণ ভাল বন্ধু। আবার বন্ধু বললেই অনেকে বলেন, ‘ওটা বলতে হয় বলে বলছ। আসলে সম্পর্ক ভাল না।’ নিশ্চয়ই দুপুরবেলায় মাছের ঝোলভাত খেয়েই কিছু লোক ভাবতে বসেন ঘোষাল আর চক্রবর্তীর লড়াইটা লাগলে বেশ ভাল হয়। তাঁরা আমাদের ট্যুইটার অ্যাকাউন্টটা চেক করেন না। দেখেন না কী ভাবে আমরা ডিনার প্ল্যান করি,” কৌশিকী বলেন।
আর সঙ্গীত পরিচালকেরা?
শ্রেয়া আর কৌশিকী? কার কোন দিকে ধার বেশি?
শান্তনুর ঘোর আপত্তি এই দুই শিল্পীর মধ্যে একটা নম্বর গেমের তালিকা বানানো নিয়ে। “শিল্প এমন একটা বৃহত্‌ জায়গা যে এখানে কাউকে উচ্ছেদ করে কারও জায়গা করার প্রয়োজন হয় না। কৌশিকীকে দিয়ে ‘লগি লগি’ গাওয়াতে গিয়ে মনে পড়ে গিয়েছিল কী রকম একই ভাবে আমি শুভা মুদগলকে দিয়ে ‘অব কে সাওয়ন’-এর মতো গান গাইয়েছিলাম। শ্রেয়া আর কৌশিকী দু’জনের মধ্যে নতুন কিছু করার খিদে আছে। সেটাই প্রশংসনীয়,” বলেন শান্তনু। তাঁর মতে জনপ্রিয়তার দিক থেকে শ্রেয়া এগিয়ে। “সিনেমা বরাবরই বেশি জনপ্রিয়। কৌশিকীকে হয়তো বলিউডের অনেকেই চেনেন না। তবে আজকাল অনেক নতুন নতুন শ্রোতা তৈরি হচ্ছেন। যাঁরা অন্য ধরনের গান শুনতে চান, তাঁদের কাছে কৌশিকীর ‘লগি লগি’টা বেশ জনপ্রিয়। আমি জানি দু’জনের মধ্যে একটা সুন্দর ভাবের আদানপ্রদান চলে,” শান্তনু জানান।
কৌশিকী চক্রবর্তী শ্রেয়া ঘোষাল
সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত কৌশিকীকে দিয়ে প্রথম বাংলা ছবির জন্য প্লেব্যাক করিয়েছিলেন ‘চ্যাপলিন’ ছবিতে ‘পত্তো কা হ্যায় জিসম্ জানম’ গানটি দিয়ে। আবার সম্প্রতি ‘মিশর রহস্য’র জন্য শ্রেয়াকে দিয়ে গান রেকর্ড করিয়েছেন। এর আগে উস্তাদ রাশিদ খানের সঙ্গে ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ গাইয়েছেন ‘তিন কন্যা’ ছবিতে।
দুই শিল্পীর শৈলী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে ইন্দ্রদীপ বলেন, “প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে শ্রেয়া অনেক এগিয়ে। কৌশিকী সবে শুরু করেছে। এবং প্লেব্যাক-এর ব্যাপারে অতটা আগ্রহী নয়। যেহেতু কৌশিকীর বিষয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, সেই গায়কির ওপর কোনও গান থাকলে মার্গীয় সঙ্গীতের মাধুর্যটা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পারে। সেমি ক্ল্যাসিকাল গানে বেশি মার্গীয় সঙ্গীতের প্রভাব না চাইলে শ্রেয়া অনেক বেশি উপযোগী। মাইকের ব্যবহারেও শ্রেয়া অনেক এগিয়ে। কৌশিকী নিশ্চয়ই কিছু দিনের মধ্যে সেটা রপ্ত করে নেবে। শ্রেয়া গানের প্রয়োজনে গলাটাকে ভাঙতে পারে। কৌশিকী সেটা সবে করতে শুরু করেছে।”
কৌশিকীর ভাষায় শ্রেয়া হল রূপে আর গুণে সরস্বতী। “পাঁচটা নতুন গান শিখে ও আমার একটা অনুষ্ঠানে গাইতে এসেছিল। টাকাপয়সা তেমন কিছু দিতেও পারিনি। বন্ধু না হলে কেন এটা করবে আমার জন্য? এটা ঠিক যে ও মাঝে মাঝে রাগাশ্রয়ী গান গায়। হয়তো আমাদের কাজের জায়গাটা কিছু ক্ষেত্রে ওভারল্যাপ করে। তবে ওঁর তো বলিউডে বেশ একটা শক্ত খুঁটি রয়েছে। তা হলে আমাকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় কেন ভুগবে ও?” কৌশিকীর প্রশ্ন।
মাধুরী দীক্ষিতের ‘গুলাব গ্যাং’-এ তিনটি গান গেয়েছেন কৌশিকী। তবে নিজের আসল কাজের জায়গাটা সম্পর্কে রক্ষণশীল তিনি। বলেন, মার্গীয় সঙ্গীতটাই তাঁর জগত্‌।
তবে হঠাত্‌ করে যে এমটিভিতে গান গাইলেন? যেটি ইতিমধ্যে ইউ টিউবে দেখেছেন ছিয়াশি হাজার তিনশো ছিয়াশি জন মানুষ। তা দেখে বাবা পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে ফোনও এসেছে। মেয়ে শো-তে ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান গাইছে’ বলে!
সামনেই একটা ফিউশন শোতে গাউন পরে গান গাইবেন। জীবনে প্রথম ফোটোশু্যট করলেন বুধবার।
আগেকার শ্রেয়া যিনি শুধুমাত্র হয়তো মেলোডি-নির্ভর গান গাইতেন, এখন নিজের গলাটাকে ভেঙেচুরে নানা ভাবে ব্যবহার করছেন। ফ্যানেরা এমনও বলছেন যে গত কয়েক বছরে গ্ল্যামারাস শ্রেয়ার মধ্যে যেন একটা ‘উল্টে দেখুন পালটে গিয়েছি’ গোছের ভাব রয়েছে। কৌশিকী কি সেই দিকেই এগোচ্ছেন?
“যখন মাত্র চারটে রাগ জানতাম, তখন ফোটোশু্যটের কথা ভাবতেই পারতাম না। শ্রেয়া যখন ‘দেবদাস’-এ গাইতে এসেছিল, তখন ও অন্য রকম ছিল। আজ ও একটা অন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে। রেওয়াজটা থাকবেই। এখন ভাবতে পারি ওয়েবসাইট করার কথা। সব কিছুই করব আমার পরিবারের ঐতিহ্য মাথায় রেখে। তাই অফ-শোল্ডার গাউন পরব না। তবে আনারকলি স্টাইলের গাউন পরতে আপত্তি নেই। গান আমার পেশা হলেও, আজও ভাবি ওটা আমার শখ। শখের জন্য তো কোনও ফোটোশু্যট লাগে না,” বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠেন কৌশিকী।
শখের জন্য ফোটোশু্যট লাগে না ঠিকই। তবে ফোটোশু্যট করলেই যে এক জন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীর শৈলীতে কিছু ঘাটতি পড়বে, তা কিন্তু নয়। “কোক স্টুডিও আমার অডিয়েন্স বেসটা বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই যাঁরা হয়তো খাম্বাজ বা চারুকেশী শুনতেন না, তাঁরা ‘লগি লগি’ শুনে আমার এই সব গানও শুনছেন। সেটা একটা বড় পাওনা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাল গান গেয়ে যদি বেশি সংখ্যক মানুষকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনাতে পারি তাতে আপত্তি কোথায়?” কৌশিকীর প্রশ্ন।
ঠিক সে ভাবেই প্রশ্ন, কেন অনেকেই বলেন যে পরীক্ষা আসছে, এ বার গানের ক্লাসে যাওয়াটা বন্ধ কর! “সরস্বতীর আরাধনা মানে পড়াশোনাকে বাদ দিয়ে গান নয়। কেন যে আমরা পড়াশোনা আর গানকে আলাদা ভাবে ভাগ করে নিয়েছি! সেটার তো কোনও প্রয়োজন নেই,” কৌশিকী জানান। তাই কৌশিকী ঠুমরির উপর পিএইচ ডি করবেন বলে ঠিক করেছেন। দর্শন শাস্ত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫-এ প্রথম হয়েছিলেন।
আসলে এত সব জল্পনার পিছনে একটা অন্য কারণ খুঁজে পান কৌশিকী। “সমাজ মেয়েদের অবলা হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত। অন্যথা হলেই গণ্ডগোল। আমি অবলা নই। তবে পায়ের তলায় মাটিটা শক্ত না হলে কিছু বলা যায় না,” বলেন কৌশিকী।
আর তার পর জানান এক বন্ধুর একটা মজার ব্যাখ্যা। শিল্পীদের কেরিয়ার নিয়ে। “প্রথম ধাপে যখন লোকে বলে, হবে হবে। তার মানে প্রতিভা আছে তবে এখনও বক্তার জায়গায় শিল্পী পৌঁছাননি। দ্বিতীয় ধাপ হল ঈর্ষা। যেখানে শিল্পী বেশ কিছুটা নাম করেছেন। তখন তাঁর সবই খারাপ। আর তৃতীয় ধাপ হল যখন শিল্পী ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তখন বলা হয় আমি তো ওকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি!”
তা কৌশিকী এখন কোন ধাপে? “আমি দ্বিতীয় আর তৃতীয় ধাপের মাঝে। ‘জংশন ফেস’। কেউ কেউ সহ্য করতে পারেন না। কেউ কেউ বলেন কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন!”
এই দ্বিতীয় ধাপের মানুষেরাই কি শ্রেয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতার গুজব রটাচ্ছেন? “জানি না। শান্তনুদার সঙ্গে অ্যালবামটা রেকর্ডিং-এর একটা ভিডিও আছে। কাজটা আমাদের কাছে একটা পিকনিক। শ্রেয়া আমাকে মাইকের কতটা সামনে গিয়ে গাইতে হবে শিখিয়ে দিচ্ছে। আর আমি দেখিয়ে দিচ্ছি একটা নোট কী ভাবে গাইলে আরও ভাল লাগবে। দু’জনে দু’জনের প্রতি খুব শ্রদ্ধা রাখি। সঙ্গীত শিল্পী আর মানুষ হিসেবে। শুধু গল্প তৈরি করার জন্য যেন আমাদের সম্পর্ক নিয়ে চর্চা না করা হয়।”

ছবি: সনত্ ঘোষ; মেক-আপ: অনিরুদ্ধ চাকলাদার



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.