|
|
|
|
|
মুমতাজকে প্রেমের উপহার |
এমনিতেই মান্না দে তাঁর মননে বহু কাল ‘বসবাস’ করেন! তার
ওপর অশক্ত
অবস্থাতেও প্রিয় গায়ক প্রয়াত স্ত্রীর জন্য
অ্যালবাম
করবেন জেনে গভীর
অভিভূত নচিকেতা চক্রবর্তী। আনন্দplus-এর জন্য কলম ধরলেন নিজেই |
|
“কুছ অ্যায়সে ভি পল হোতে হ্যায়
যব রাত কী গহরি সন্নাটে
গহরি সি নিন্দ মে সোতে হ্যায়
তব মুসকানো কী দর্দ ইঁয়াহা
বচ্চো কে তরহা রোতে হ্যায়”
বয়স তখন অনেক কম, তবুও চমকে উঠেছিলাম আতঙ্কিত হয়েছিলাম যদিও আতঙ্কিত হওয়ার কোনও বয়স থাকে না। কারণ আজও গানটা মনে করলে আমার শিরদাঁড়ার নীচ দিয়ে একটা শূন্যতা জড়ানো অনিশ্চিত আতঙ্ক মস্তিষ্কে পৌঁছে এক ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি করে কীসের এ ভয়? এ ভয় শূন্যতার, একাকীত্বের, এক গভীর জীবনবোধের। ছোট বয়সে গানটা শুনে কেন জানি না ভয় পেয়েছিলাম। আজ এই বয়সে পৌঁছে এই ভয়টার সঙ্গেই ঘর করি আমরা সবাই।
সেই গানটা পরিবেশন করেছিলেন মান্না দে। গেয়েছিলেন বলতে পারতাম। কিন্ত গাওয়ার বাইরে আরও অনেক কিছু তিনি করেছিলেন সেটা ভাষায় বা স্বরলিপির শাসন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
কিছু দিন আগে আনন্দplus-এ গৌতম ভট্টাচার্যর ওঁকে নিয়ে একটা লেখা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অবশেষে সেই দিনটা তা হলে এসেই গেল।
“কুছ অ্যায়সে ভি পল হোতে হ্যায়
যব রাত কি গহরি সন্নাটে
গহরি সি নিন্দ মে সোতে হ্যায়
তব মুসকানো কি দর্দ ইয়াহা
বচ্চো কে তরহা রোতে হ্যায়।” |
|
একজন প্রাণচঞ্চল মানুষ কোটি কোটি মানুষকে বলেছেন
“সামনে যা দেখি জানি না সে কি আসল কি নকল সোনা
জীবনে কী পাব না ভুলেছি সে ভাবনা।”
না আমরাও ভাবিনি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম জীবনের অসমান যুদ্ধে। আজ উনি আবার মনে মনে গাইছেন,
“জীবনের কত কাজ সারা হয়ে গেল
আরও কত বাকি রয়ে গেল, মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায়।”
গানের ব্যাখ্যা, ওঁর সঙ্গীত জগতে দান কতটা, তা বর্ণনা করার শিক্ষা আমার নেই। তবে এটা বলতেই হবে মান্না দে-র প্রথম বাংলা গানে লিগাটো ফর্ম বা মিড়-কেন্দ্রিক গানের ধারাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।
বাংলা গান যখন মিড়-কেন্দ্রিক গানের ঘেরাটোপে বদ্ধ ছিল, মান্না দে একটা নতুন গায়কি নিয়ে এলেন।
“কে প্রথম কাছে এসেছি
কে প্রথম ভালোবেসেছি”
এখানে বোঝা যায় একটা বিদেশি অ্যাকসেন্টকে কী করে ভারতীয় গায়কি দিয়ে একটা নতুন ধারার জন্ম দেওয়া যায়।
আজও আমরা যারা কথাপ্রধান গান গাই মাথার পেছনে মান্না দে-র উচ্চারণ প্রক্ষেপ অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শুনেছিলাম উনি আমার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এই লেখাটা যদি উনি পড়েন তা হলে বলব, “দাদা, ওই গানটা আমি আপনার গায়কি অনুসরণ করেই গেয়েছিলাম।” |
অন্তিম প্রেমার্তি:
কাজ শুরু করে দিয়েছেন তিনি। স্ত্রী-র শ্রদ্ধাঞ্জলিতে বেছেছেন চারটি রবীন্দ্রসঙ্গীত, তিনটি নতুন গান। কলকাতায় এখন মিউজিক ট্র্যাক বানানো চলছে। শরীর ভাল থাকলে মার্চে বেঙ্গালুরুর স্টুডিওতে গিয়ে ডাব করবেন মান্না দে।
ক্যাসেটটি পরিচালনায় আশা অডিও |
|
শুনেছি উনি শর্ট হ্যান্ডে গানের নোটেশন লিখতেন। এটা নাকি ও পি নায়ার ছাড়া আর কেউ করতেন না।
ছোটবেলা থেকেই মান্না দে আমার আইকন ছিলেন। তখন বাংলা গান দুই মেরুতে বিভক্ত ছিল। হেমন্ত আর মান্না। খানিকটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো। আমি ছিলাম মান্না দে-পন্থী। আমার স্কুলে সুদেব দে পড়ত। আমি ওর সঙ্গে ভাব করেছিলাম শুধু আমার আইকনের ভাইপো বলে।
স্কুলে দুষ্টুমি করলেও পার পেয়ে যেতাম, মান্না দে-র গানগুলো গাইতাম বলে। ক্লাসে তো বেঞ্চ বাজিয়ে গাইতাম ‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না’। আর শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাকে টিচার্স রুমে ডেকে নিয়ে ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না’ বা ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়’ গাইতে বলতেন। মনে আছে ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’ তো পাড়ার দাদারা খেলা থেকে তুলে এনে রকে শুনত। বাহবা পেতাম তার জন্য। স্কুলে হোক কী পাড়ায়।
সেই বাহবাকে পাথেয় করেই পরে গান গাইতে এলাম। আজ যত বাহবা পাই, তার সিংহভাগটাই মান্না দে-র জন্য তোলা আছে। মান্না দে-র গান সেই সময় সব চেয়ে স্মার্ট ছিল ওঁর মারাত্মক পরিমিতি বোধে। একটুও বেশি কিছু করতেন না। আর সবটাই ছিল শাস্ত্রীয়। |
|
নেতাজি ইন্ডোরে সে দিন পাশাপাশি |
‘বড় একা লাগে এই আঁধারে’ গানটা কম্পোজিশন হিসেবে খুবই সাধারণ। কিন্তু উনি শুধু গেয়ে গানটাকে অমর করেছিলেন। এ রকম অসংখ্য গান আছে যা উনি ওঁর স্মার্ট গায়কি দিয়ে দাঁড় করিয়েছিলেন। সুরকার হিসেবেও উনি অসাধারণ। ‘আমায় তুমি যে ভালোবেসেছ’ বা ‘যখন আকাশটা কালো হয়’ আশা ভোঁসলেকে দিয়ে উনি প্রথম যে বাংলা গান করিয়েছিলেন, তা আশাজির পরের বাংলা গানের থেকে অনেক উচ্চমানের।আমি মান্না দে-র অনেক গান জানি যা অনেকেই শোনেননি, সেগুলো ওঁর নন-ফিল্মি গান যা রেডিওতে শুনে শুনে শেখা। সে সব গান শুনলে বোঝা যায় ওঁর লিরিক চয়ন। যেমন ‘মধুশালা’, ‘সাওয়ন কে রিম ঝিম মে’, ‘কিস তট বাধে’, ‘সুনসান যমুনাকে কিনারা’। এ রকম অসংখ্য গান, যা অনেকেই জানেন না। এ সব গান শুনলে বোঝা যায় উনি কত সংবেদনশীল, বোধসম্পন্ন মানুষ, যিনি নিজেকে একটা শক্ত বর্মের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি ওঁকে চিনি না। দেখেছি এক কনসার্টে। এইটুকুই। কিন্তু উনি আমার খুব চেনা, কারণ আমার মধ্যেই ওঁর বাস।
আমার প্রেমের শুরুও মান্না দে। যত বার আমার প্রেম হয়েছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইম্প্রেস করার হাতিয়ার ছিল মান্না দে-র গান। আমার স্ত্রীও তার মধ্যে একজন। আমার স্ত্রী তো চেয়েছিল মান্না দে-কেই বিয়ে করবে। আমি যেহেতু মান্না দে-র মতোই গাইতাম, তাই ‘সেকেন্ড চয়েস’ হিসাবে আমাকেই বেছেছিল।
আনন্দplus-এর লেখা পড়ে জানলাম মান্না দে শেষ একটা কাজ করে যেতে চাইছেন। স্ত্রী-বিয়োগের পর বিষণ্ণ উনি ওঁর স্ত্রী-কে উৎসর্গ করে একটা অ্যালবাম করে যেতে চাইছেন।
সেটাই হয়তো হবে জীবনের শেষ বড় কাজ।
আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি একজন বিরহী মানুষ একটি চেনা ঘরে চেনা সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে ওঁরই গাওয়া একটি পুরোনো গানের কথা ভেবে বলেছেন,
“সুনসান যমুনা কি কিনারা
পেয়ার কা অন্তিম সাহারা
চাঁদনি কা কফন ওড়ে
সো রহা কিসমত কা মারা
কিসসে পুছু ম্যায় ভলা অব
দেখা কহি মুমতাজ কো?
মেরি ভি ইক মুমতাজ থি
মেরি ভি ইক মুমতাজ থি।”
আধুনিক সময়ে চারদিকে শুনি, ভ্যালেনটাইন’স ডে আর প্রেম দিবসের সেরা উপহার নিয়ে। একটা মানুষ, থুড়থুড়ে তিরানব্বইতে পৌঁছে, হাজার হাজার সুপারহিট গান গেয়ে, শরীরে ক্যাথিটার জড়িয়ে থাকা অবস্থায় প্রয়াতা স্ত্রীর জন্য গাইতে চাইছেন। প্রেমের এর চেয়ে বড় মনুমেন্ট আর কিছু হতে পারে!
|
আবার হবে তো দেখা
এটাই তো সর্বকালের ভাবনা।
এটাই তো সর্বকালের জিজ্ঞাসা,
‘এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো?’ |
অপবাদ হোক না আরও
যখন সেই প্রেমের সন্ধিক্ষণে
দাঁড়িয়ে রয়েছি। এই গানটাই
ছিল আমার ‘লাইসেন্স টু লাভ’। |
অসম্ভব লেগেছিল!
একদিন দল বেঁধে কী সুন্দর দার্শনিক
চিন্তা, ‘কেউ তো জানে না, মনেরই
ঠিকানা’। ভাল না লেগে পারে! |
হয়তো তোমারই জন্য
এই গানের মাঝের একটা লাইন ছিল
‘আমি যে নিজেই মত্ত, জানি না তোমার
শর্ত’। আমি তো এ রকমই। অন্যের
‘শর্ত’তে তো কোনও দিন প্রেম করিনি।
নিজের ‘মত্ত’টাই আমার কাছে প্রেম। |
আমি যে জলসাঘরে
আমার শোনা কথা, রফি সাহেবের
গাওয়া ‘মেরে মেহেবুব তুঝে মেরি মহব্বত
কি কসম’-এর রাগ আর কর্ড ব্যবহার
করেই অনিল বাগচী সুর দিয়েছিলেন।
মান্না দের গলায় কী যে |
আজ আবার সেই পথে
ঘটনাটা আসলে আমার
জীবনে ঘটেছে। ব্যাপারটা এতটাই
সিরিয়াস, তার নাম উল্লেখ
করে ঘটনার গুরুত্বকে
লঘু করব না। |
|
|
|
|
|
|