ভিড়ের গুঁতোয় ছুটবে কোথায় প্রেম তালকানা |
কোথাও বোর্ড বলছে, সুয্যি ডুবলে এখানে বসা মানা। কোথাও কোনও বোর্ডই নেই। হাজার চোখ হ্যাজাক জ্বেলে ঘুরছে।
প্রেমটা লোকে করবে কোথায়!
জায়গা বড়ই অকুলান। আর প্রেমও তো আবার এক রকম নয়। কারও বাদামভাজা প্রেম তো কারও লুডো খেলা। ফলে জায়গাও চাই নানা রকম। কোথাও ফুচকা লাগে, তো কোথাও একটু আড়াল লাগে, ছায়া লাগে। সে বড় হ্যাঙ্গাম!
শিলিগুড়ি থেকে দুর্গাপুর, খড়্গপুর থেকে কৃষ্ণনগর জেলার যে কোনও শহরেই প্রেমের প্রায় একই রকম ‘কোথা যাব নাথ’ দশা।
শিলিগুড়ির বাঘা যতীন পার্কে যেমন দিব্যি ঝোপঝাড়-আলোআঁধারি রয়েছে। কিন্তু একে অন্যের কাছে একটু কাছে ঘেঁষতে গেলেই মাটি ফুঁড়ে পুলিশ হাজির! কে যাবে মরতে? শহরের কলেজ-পড়ুয়া ঋদ্ধিমানের আবার মনখারাপ, “আগে মহানন্দার তীরে সূর্য সেন পার্কে চুটিয়ে প্রেম করা যেত। তার পর পুরসভার নজর পড়ল পার্ক সাজাও! প্রথমে ভেবেছিলাম, আহা! ও বাবা! এখন কাচ্চাবাচ্চা আর বুড়োদের মর্নিং ওয়াক-ইভনিং ওয়াকের ঠেলায় প্রেম ভোঁ-কাট্টা।”
আজ ভ্য ালেন্টাইন্স ডে-তে ভালবাসার মানুষ তবে যাবে কোথায়? |
দুর্গাপুরে না-হয় কুমারমঙ্গলম পার্কের মধ্যেই প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য ‘লাভার্স জোন’ রয়েছে। সারা বছরই গাছগাছালির ফাঁকে দেখা মেলে প্রেমিক যুগলের। তবে তা-ও নিশ্চিন্তিপুর নয়। বেয়াদপ ছেলের টিটকিরি রয়েছে। রয়েছে পুলিশের ভয়। মোটরবাইকের পিছনে প্রেমিকাকে বসিয়ে ছুট দিলে কিলোমিটার দশেক দূরে নাচন ড্যাম বা দ্বিগুণ দূরত্বে দেউল পার্ক কিছুটা নিরিবিলি অবকাশ দিতে পারে।
শিলিগুড়ির প্রেমিকদেরও তেমনই বন দফতরের সরিষা পার্ক বা সুকনার মধুবন পার্ক ছাড়া গতি নেই। আর আছে সিটি সেন্টার বা সেবক রোডের শপিং মল। এর বাইরে যে সব কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এক সময়ে প্রেমের স্বর্গরাজ্য ছিল, সেখানেও বিধি বাম। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তো রীতিমতো বোর্ড লাগিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিকেল ৫টার পরে ক্যাম্পাস চত্বরে বসবেন না। ফলে ছাত্রছাত্রীরা, বিশেষত যাঁরা হস্টেলে থাকেন, তাঁদের আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শিবমন্দির চত্বরে জাতীয় সড়কের দু’পাশে গজিয়ে ওঠা কচুরি-জিলিপির দোকান!
আজকাল বেশ কিছু রেস্তোরাঁ গজিয়েছে বটে। বাতানুকূল, নিভু নিভু আলো। কিন্তু পকেটে রেস্ত না থাকলে সেখানে ঢুকবে কে? কলেজ পড়ুয়াদের তো পকেট ঢনঢন। তার উপরে বহু জায়গাতেই পর্দার আড়াল দেওয়া কেবিন নেই। অনেকের মতে অবশ্য, এ সবের থেকে নদীর পাড় ঢের ভাল! ফুরফুরে হাওয়ায়, প্রেমিকার এলোমেলো চুলে বা প্রেমিকের পাঞ্জাবির খোলা বোতামে প্রেম লুটোপুটি খায়। কিন্তু ভাগীরথীর পাড়ে বহরমপুর বা চূর্ণীতীরে কৃষ্ণনগরের ছেলেমেয়েরা অন্য কথা বলেন। ভাগীরথীর ধারে এক সময় বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বসে দিব্যি প্রেম করা যেত। কিন্তু তৃতীয় সড়ক গজিয়ে ওঠার পর থেকেই পাড় বরাবর নিয়ন আলো ভূত আর প্রেমকে যেন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।
কলেজ-পড়ুয়া স্মিতা ভট্টাচার্য বেশ রেগেই বলেন, “বহরমপুরে আবার প্রেম করার জায়গা আছে না কি!” ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন লালবাগের পার্ক। শহরেরই অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় আবার সন্ধ্যায় বান্ধবীকে নিয়ে লালদিঘি পার্কে যাওয়ার কথা ভেবেছেন। তাঁর কথায়, “এই একটাই নিরিবিলি জায়গায় তো আছে।” বাকি যা আছে, বহরমপুরের ব্যারাক স্কোয়ার বা ওয়াইএম ময়দানে এত লোক আর এত আলো যে সন্ধ্যার পরে টেকা দায় বলেই মত অধিকাংশের। কৃষ্ণনগরের সৌমাভ আবার বলেন, “চূর্ণীর পাড়ে পুলিশের বড্ড অত্যাচার। বান্ধবী তো দূর, আজকাল বন্ধুকে নিয়েও একটু বেশি ক্ষণ বসলে পুলিশ এসে দু’বার তাড়া দিয়ে যায়। কিছু দিন পরে বোধহয় শহরের মাঝখানে পোস্ট অফিসের মোড়ে বসে প্রেম করতে হবে!”
উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে আবার না আছে পার্ক, না আছে নদী। হাতিপুকুর বলে যে একটি মাত্র পার্ক ছিল, তা-ও এখন সমাজবিরোধীদের আস্তানা। বুক ছমছম ভয় নিয়ে সেখানে যাওয়ার সাহস বিশেষ কেউ দেখান না। তার উপরে আকছার শ্লীলতাহানি আর ইভটিজিংয়ের বাজারে কে-ই বা ও দিক মাড়ায়। এ শহরে তাই ব্যস্ত রাস্তাই ভরসা। কিন্তু পাড়া-বেপাড়ার গুরুজনদের চোখ এড়াবে কে? খড়্গপুর শহরেও পার্ক নেই, নেই ভাল আড্ডা বা সময় কাটানোর জায়গা।
লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্য অবশ্য মনে করেন, “প্রেম করতে চাইলে জায়গা ঠিকই খুঁজে পাওয়া যায়। মাঠে, পার্কে বা শপিং মলে দিব্যি আশপাশ ভুলে প্রেম করে ছেলেমেয়েরা।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ঈপ্সিতা হালদারের মতে, “প্রেম গোপন করা হয় বলেই তা উদ্যাপনের দিন খুঁজতে হয়। জেলাশহর বা মফস্সলে অবাধে মেলামেশার সুযোগ থাকলে প্রেমিক বা প্রেমিকার বাড়িতে বসেই তো সময় কাটানো যায়।”
কিন্তু সেই বুকের পাটা আর ক’জনেরই বা আছে? কথা হল, নদীর পাড়ে বনের ধারে যাঁরা প্রেম করতে চান, ট্যারা লোকের বাঁকা চোখ বা পাজি নচ্ছার সমাজবিরোধীরা তাদের জ্বালাতন করতে পারে। পুলিশ প্রেমের বৈরী হবে কেন?
প্রাক্তন পুলিশকর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায়ের মতে, “স্বাভাবিক নিয়মেই ছেলেমেয়েরা মিশবে। সময় কাটাবে। অকারণে পুলিশের ধরপাকড় একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। তবে আপত্তিকর অবস্থায় কাউকে দেখলে অবশ্যই ভদ্র ভাবে জানানো উচিত যে, এটা পাবলিক প্লেস। সংযত থাকা উচিত।”
তেমন পুলিশ দেখলে তো বসন্তের কোকিলও প্রেমে পড়ে যাবে!
|
(তথ্য: কৌশিক চৌধুরী, সুমন দে, শুভাশিস সৈয়দ, অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও অর্পিতা মজুমদার) |