|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
১০০,০০,০০,০০০ জাগছে |
আজ কলকাতাতেও জমায়েত। সারা পৃথিবীর সঙ্গে শপথ নেব আমরাও।
যৌন হিংসায় আর চুপ না থাকার শপথ। আমাদের সঙ্গে থাকবে সেই পুরুষরাও,
যারা ভালবাসে। ভালবাসতে জানে। আজ ভালবাসার দিন। শাশ্বতী ঘোষ |
এক নতুন স্লোগানের ঝংকার রণিত হচ্ছে আবিশ্বে। এই নতুন সর্বহারা একশো কোটিরা নারী। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব গত বছরে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, তথ্য বলছে, প্রতি তিন জনে এক জন মেয়ে সারা জীবনে কোনও-না-কোনও ধরনের হিংসার শিকার হবেন। নাট্যকার ইভ এন্সলার (ভ্যাজাইনা মনোলগ্স লিখে বিখ্যাত বা কুখ্যাত) বললেন, এই হিসেবে সারা পৃথিবীতে মানুষই আছে মোট সাতশো কোটি। এর মধ্যে অর্ধেক মেয়ে। আর তার মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ মেয়ে যদি যৌন বা পারিবারিক হিংসার শিকার হন, তা হলে হিসেবটা দাঁড়ায় শত কোটির কিছু বেশি। আজ শত কোটি মেয়ে আর তাদের ভালবাসে যে পুরুষরা, তারা সবাই মিলে যদি বলে: মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসা আজ, এখুনি বন্ধ করো, তা হলে কেন হিংসা চিরতরে বন্ধ হবে না? তাই তিনি বেছে নিলেন এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে। এ দিনই তো সারা পৃথিবী জুড়ে নারী ও পুরুষ তাদের প্রিয়তম বা প্রিয়তমা বিশেষ মানুষটির জন্য তাদের ভালবাসার শপথটাকে আরও একটু জোরদার করে। সেই শপথ এ বার আসুক না যৌন হিংসার বিরুদ্ধে শপথ হিসেবে? তাই ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেল চারটে থেকে শহিদ মিনার সেজে উঠছে এক অন্য ধরনের জমায়েতে। নারী ও পুরুষ, গ্রাম ও শহর সরব হয়ে উঠছে মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসার শপথে— রোখো! জাগো! নাচো!
গত সেপ্টেম্বরে এই ডাক দিয়ে ইভ ঘুরেছেন সারা পৃথিবী। প্রায় পনেরো বছর আগে ইভ তৈরি করেন তাঁর নিজস্ব সংগঠন ভি-ডে, সেটাও ছিল এক ১৪ ফেব্রুয়ারি। নিজেও শৈশবে নিকটাত্মীয়ের যৌন হিংসার শিকার ইভের কাছে ভি অক্ষরের তাৎপর্য একটাই— ভায়োলেন্স। তাই তাঁর কাছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র ভি বর্ণটিকে ছাপিয়ে ওঠে ভায়োলেন্স। তিনি বলেন, পুরুষরা মেয়েদের যোনিকে দখল করতে চায়। তাই তাঁর সংগঠন ভি-ডে’র স্লোগান, হিংসাকে মুছতে হলে যোনির ওপর এই দখলদারিকে জয় করতে হবে— ‘ভিকট্রি ওভার ভ্যাজাইনা’। |
|
ভিকট্রি ওভার ভ্যাজাইনা। ইভ এন্সলার (বাঁ দিকে) ও অভিনেত্রী থ্যান্ডি নিউটন। ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। ছবি: এ পি |
তিনি যখন নারী সংগঠনদের সঙ্গে আলোচনার জন্য সারা পৃথিবী ঘোরার পরিকল্পনায় ভারতে আসেন, তখন ভারতে ঘটছে সেই অভূতপূর্ব ঘটনা— দিল্লির বাসে গণধর্ষণের শিকার মেয়েটি ও তার বন্ধুর জন্য মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পথে নেমে বিচার চাইছেন, পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, জলকামানে ভিজছেন। এই দৃশ্য দেখে ইভ বললেন, মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসা থামানোর এই লড়াইতে তো ভারতকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। সারা ভারতে মেয়েরা, এবং তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে পুরুষরাও নানা ভাবে হিংসার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের ভাবনা ভাবছেন, ভাষা খুঁজছেন।
|
হিংসার বৃত্তের বাইরে |
দিল্লির ঘটনায় আক্রান্ত তরুণতরুণী বাস থেকে ঠেলে ফেলে দেবার পর দীর্ঘ সময় রাস্তার ধারে ওই ঠান্ডায় বিবস্ত্র হয়ে পড়ে ছিলেন, পথচলতি নাগরিক মানুষরা কেউ সহায়তার আবেদনে সাড়া দেননি। দিলে হয়তো ছাত্রীটির বাঁচার সম্ভাবনা একটু বাড়ত। ঔদাসীন্যের এই বাতাবরণে তাই পাকিস্তানে মেয়েদের অপহরণ, বাংলাদেশে অ্যাসিড আক্রমণ বা শ্রীলঙ্কায় তামিলা টাইগার আর সেনাবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে মেয়েদের উপর হিংসা বা যৌননিগ্রহ বাড়ছে বলে যে তথ্য প্রকাশিত হয়, তা খুব বিস্মিত করে না। আশির দশকে মহারাষ্ট্রে পুলিশি হেফাজতে মথুরা বা হায়দরাবাদের রামিজা বি-র ধর্ষণ মেয়েদের ওপর যৌন হিংসার বিরুদ্ধে ভারতের নারী আন্দোলনকে সংহত করে, যেখানে আজ দিল্লির ঘটনার পরে পথে পথে দলহীন অনামা মানুষের প্রতিবাদী ভিড়। বর্মা কমিশন বা নতুন অর্ডিন্যান্স যতই মনে করুক না কেন, যৌন নিগ্রহের যে-কোনও ঘটনাকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে, বাস্তবে মেয়েরা ‘ছোটখাটো’ বলে মনে হলে সে-সব ঘটনায় প্রশাসন বা আদালতের কাছে যেতে চায় না— কারণ তারাও আশঙ্কা বোধ করে যে, তাদের হয়তো বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাবে, অনেকেই হয়তো বা মনে করবে যে সে বাড়াবাড়ি করছে। পুরুষমানুষ এ রকম করবেই— এ ধরনের ভাবনা তো আমাদের বন্ধু-সঙ্গী-সহনাগরিক বহু পুরুষের প্রতি এক ধরনের অনাস্থার প্রকাশ— আমরা কি সেটুকু করেই ছেড়ে দেব? মনে মনে জানব, পুরুষমানুষ ‘আসলে’ বদলাবে না?
পুরুষরা মেয়েদের কী চোখে দেখছেন? দখলদারির বাইরে গিয়ে কোনও সম্পর্ক স্থাপন করা কি আদৌ সম্ভব নয়? দিল্লি ঘটনা দেখিয়েছে— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন পুরুষরাও। ভারতীয় পুরুষদের জন্য সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আরও জরুরি। ২০০৯-১০ সালে সমীক্ষা চালানো হয় পৃথিবীর ছ’টি দেশে, যে দেশগুলিতে মেয়েদের সহনাগরিক হিসেবে মানার বিষয়ে পুরুষরা মোটেই প্রস্তুত নন, অর্থাৎ সে দেশগুলিতে পুরুষপ্রধান মনোভাব বেশ গভীরে গেঁথে রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ভারত, চিলি, ব্রাজিল, মেক্সিকো, রুয়ান্ডা আর ক্রোয়েশিয়া। পুরুষরা মেয়েদের সমান অধিকার নিয়ে কতটা সচেতন বা কতটা পর্যন্ত মেয়েদের সমান বলে মানতে প্রস্তুত, তা জানতে চেয়েই এই সমীক্ষা। ১৮-৫৯ বয়ঃসীমার আট হাজারের বেশি পুরুষের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়। যেমন, কাজের চাপ, বাড়ির কাজ ভাগ করে নেওয়া, সহবাসের সময় গর্ভনিরোধক কে ব্যবহার করবেন সে সিদ্ধান্ত নেওয়া, সন্তানজন্মের সময় উপস্থিত থাকা বা ছুটি নেওয়া, সন্তানের দায়িত্ব পালন, প্রেমিকা বা স্ত্রীকে শারীরিক বা মানসিক আঘাত করা, অপরাধমূলক কাজে অংশ নেওয়া, বারবনিতাগমন বা অর্থের বিনিময়ে যৌনসম্পর্ক, সমকামীদের সম্বন্ধে ধারণা, মেয়েদের জন্য নানা সমতার নীতি সম্বন্ধে জানা বা তার বিরোধিতা— পৌরুষের চলতি মাপকাঠি তৈরি করে যে সমস্ত বিষয়, সেগুলিতে কোন দেশে কত শতাংশ পুরুষ সহমত বা বিরোধী, তার একটি ছবি উপস্থিত করে বিখ্যাত নারী বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন উইমেন। এই সমীক্ষা শুধু পুরুষদের ধরেনি, পুরুষরা যা বলছেন, সেগুলি সত্যি কি না, মেয়েদের অভিজ্ঞতা সে বিষয়ে কী, সেটা জানতে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মেয়েকে প্রশ্ন করে। তাতে দেখা যায়, অধিকাংশ বিষয়ে ভারতীয় পুরুষরা সবচেয়ে নারীবিরোধী, সঙ্গে হাঁটছেন রুয়ান্ডার পুরুষরা। তাই দিল্লির বাসে গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর ইভ এন্সলার যখন বলেন যে, ভারতীয়দের এ বিষয়ে সামনে থাকতে হবে, তার একটা অন্য তাৎপর্য তৈরি হয়। ওই ঘটনার পর একটি সমীক্ষা দেখিয়েছিল, ধর্ষণের অভিযোগকারিণীদের খাস দিল্লির পুলিশরা কী হীন চোখে দেখে!
|
অন্য উচ্চারণের সন্ধানে |
যে ক্রোধের উপশমে বক্তৃতা পৌঁছতে পারে না, গান হয়তো পৌঁছতে পারে। নানা ভাবে, নানা উচ্চারণে হিংসার বিরুদ্ধে মনের সেই স্তরটাকে ছুঁতে চাইছেন অনেকেই। নাচে-গানে-নাটকে। সেগুলো লিখতে গিয়ে, মহলা করতে গিয়ে, দেখতে গিয়ে মানুষের মনগুলো বদলায় কি না দেখা যাক। শতকোটির উত্থান অন্য উচ্চারণে সবাইয়ের কাছে পৌঁছোতে চাইছে। যে মেয়েরা সম্মানের নামে নিহত হয়েছে, মল্লিকা সারাভাই কালো পোশাকে নিজেদের মুড়ে তাঁর ‘দস্তক’ বা ‘ডানা-ভাঙা-মেয়েদের কথা’ নৃত্য উপস্থাপনায় তাদের যন্ত্রণার কথা বলেছেন। পুণের মেয়েরা নতুন আশার সন্ধানে চলচ্চিত্র উৎসব করছে এই নতুন ভাষা খুঁজতে। রবিন্দর রণধাওয়া-স্বরভাস্কর গান লিখে গাইছেন: ‘ও মাগো দেখো! ওরা ছ’জন ছিল, কিন্তু আমি ভয় পাইনি, আমি তোমার মতো হব না, আমি হাসতে হাসতে ফিরব, আবার বাঁচতে, আরও বড় হতে, আবারও সাহস করতে...’ এ রাজ্যে ক্রসউইন্ডস ব্যান্ড শতকোটির সুর দিয়েছে উঠে দাঁড়ানোর এই গানে।
সারা পৃথিবীর ১৪০টি দেশের, পাঁচটি মহাদেশের নারী-পুরুষ এই দিনে ‘আর হিংসার ঘটনায় চুপ থাকা নয়’ বলে শপথ নেবেন। থাকবেন সেই মেয়েরাও, যাঁরা হিংসার বলি না-হয়ে উত্তরণের পথ খুঁজে দাঁড়িয়েছেন অন্যদের পাশে। আমার দেশের, আমার রাজ্যের মেয়েরাও সেই শপথে শামিল। শপথ নেব হিংসার বিরুদ্ধে রুখব-জাগব-নাচব। শতকোটির উত্থানে-উত্তরণে আমরা অংশীদার, আমরা সাক্ষী। সঙ্গে থাকবেন সেই পুরুষরা যাঁরা ভালবাসেন। ভালবাসতে জানেন। আজ ভালবাসার দিন। |
|
|
|
|
|