প্রবন্ধ ৩...
বাই বাই সরস্বতী, হ্যাপি ভি’ডে
হোমযজ্ঞের ইট বালি কাঁচা কাঠ, জামবাটিতে মধুপর্ক, পঞ্চগব্য, পঞ্চঘৃত, মস্যাধার, লেখনী, গাঁদার মালা, কুচো ফুলের স্তূপ— পুজোর ফর্দ মেলালে এতটুক ভুলচুক পাবেন না। কেবল বেলাটা খানিক গড়ালেই দেবীমূর্তির দু’ধারে, সশীষ ডাবের সঙ্গী লাউডস্পিকারদ্বয় ফাটাস্বরে গাঁকগাঁক গাইবে, লাভ লাভ লাভ লভেরিয়া হুয়া।
এ পুজোয় বরাবরই ওদের হক বেশি। এক দল বারো ইয়ার শেষ শীতে আপনার বাড়িতে বহুবার কড়া নাড়ে। চাঁদা বই দেখে বারংবার মুখস্থ ও প্র্যাকটিস করেছে, তবুও দশের মধ্যে ন’বার আমতা আমতা করে বলবে, ‘স্ব-র-স্ব-তয়ে দীর্ঘ ঈ, না কি হ্রস্ব ই’? আর এক দলকেও ভালই চেনেন। ফ্ল্যাশব্যাকে যান। ক্লাসের কিছু বাছাই জুয়েল। এদের স্কুল ইউনিফর্মই অন্তত পাঁচ-ছ সেট, প্রতি দিনই জামা উজালা সফেদি বর্ষায়, কলেজ গেলে চকচকে হাতঘড়ি আর ফি-সপ্তাহের নতুন পোশাক চিল্লায়: শাহজাদ-এ-আমিরিস্তান পধার রহে হ্যায়। দ্বিতীয় আইডেন্টিটি, একটি অতি আশ্চর্যের বিষয়। সারা বছরই ব্যাগউপচানো মলাটশোভিত বইখাতার নিদাগ, নিভাঁজ সৌন্দর্য এতটুকু টোল খায় না। রহস্য সমাধান হয় এরা ক্লাসে পড়া বলতে উঠলেই। কোনও প্রশ্নেই ঠোঁটের দরজা ফাঁক হয় না। এরাই সরস্বতী পুজোয় অন্যতম হ্যাপি ও বিজি পাবলিক। বাড়িতে ফাটিয়ে পুজো হয়, এক তলা সাইজের ঠাকুর, তিন দিন গোটা পাড়া সারা ক্লাসের কচুরি খিচুড়ি নেমন্তন্ন। ভাসানের দিন বুক চিতিয়ে কাঁসর বাজাবে ও র্যেলা নেবে, দেখ বিদ্যের দেবী কেমন আমার শুধু আমার। রেজাল্টের দিন সেই বুক ও মুখ কুঁকড়িয়ে আমসি।
তার পর আছেন অধুনার অসীম বিদ্যেধর, দিগগজ পণ্ডিত এবং শিল্পীমণ্ডলী। পুরাণ-টুরাণ ঘেঁটেঘুঁটে বহু ভেবে বিধান দিয়েছেন, নাহ্, সরস্বতীকে মা বলে ডাকা যায় না। এ যে অত্যন্ত সুদর্শনা তরুণীমূর্তি। কুমোরটুলিতে কখনও মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও শ্রীদেবী। আর ফেয়ারনেস ক্রিমের মডেল হলে তো কাঁপিয়ে দিতেন। ফ্যাশনদুরস্ত শাড়ি, বীণা হাতে নিখুঁত কোডাক মোমেন্ট। হালকাপুলকা রসিকা রসিকা হিরোয়িনি হাবভাব। ও দিকে কেউ বলে ব্রহ্মার স্ত্রী তো কেউ বলে স্বামী নারায়ণশিলা। না কি, এখনও মিস্। অতএব স্বপ্ন দ্যাখো আর ছবি এঁকে বিক্রি করো। পুজোটাও আবার বসন্তপঞ্চমীতে। চারি পাশে কচিকাঁচা ছেলেমেয়ের ঘুরঘুর, তাদের মধ্যে ইলু ইলু করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটাও নিশ্চয়ই তাঁরই। সব মিলিয়ে দাঁড়াল, সরস্বতী ইজ ইক্যুয়াল টু প্রেম, প্রেমিকা, ফার্স্ট ডেটিং...
তার মধ্যে আমরা গোনাগুনতি ক’জনাই দেখছি বেহদ্দ বোকা। বেবাক ক্যাবলার মতোই বলতে যাই, আচ্ছা, এই একটা দিন না হয় চুপ করে একটু বসলাম। মনটাকে একটু গোছালাম, শান্ত করলাম, ধুয়েমুছে অমনিধারা সাদা করে ফেললাম। যে সারা বচ্ছর আমি একটু পড়ব, শিখব, জানব। ওই সাদা মনে একটু একটু করে ঐশ্বর্য জমাব। রাজহাঁসটার মতো। ছেঁকেছুঁকে দুনিয়াশুদ্ধু ভাল জিনিসগুলো নিজের অন্দরে পুরব...
‘চোপরাও’।— কে চেঁচাল? সেটা দেখতে পাচ্ছি না, তবে চারধারটা দিব্যি দেখছি আর বুঝছি। ওরাই দাবড়ে থাকবে। ওই যে, কেমন একখানা কুচকুচে অভদ্র অভব্য নিকষ অশিক্ষিত সমাজ। দিন কে দিন আরও কালো পাঁকে ডুবছে। শ্বেতাম্বরা শ্বেতচন্দনচর্চিতা শ্বেতপদ্মাসনা এমন সফেদি কি চমকার পরমপবিত্র দেবী এ চুলোয় কোথায়? যদি আসেনও, বসতেটা দেব কোথায়!
ঠিক। মেট্রোর ভিড় থেকে পথচারীদের আচরণে, নেতাদের তরজায়, আশপাশের সব রকমের কলরবে, জীবনযাপনে কান পাতলে চোখ মেললেই বোঝা যায়, সরস্বতী এই এরিয়া থেকে বহুকাল বিদায় নিয়েছেন। এখন বসন্তপঞ্চমী তিথি হল ইংরেজদের ১৪ ফেব্রুয়ারিটার প্রতি বাঙালির সমুচিত জবাব। চটপট পুজোটা ফিনিশ করে শাড়ি আর শেরওয়ানি পরে বেরিয়ে পড়। তার পর যা হয়। সারা বছর দেবী ভাঙা চালচিত্র নিয়ে ধুলোময়লা মেখে চিলেকোঠায় একলা বসে থাকবেন।
বিদ্যাকে গঙ্গায় দিতে নেই কি না!
বাই বাই শ্রীপঞ্চমী। ভাল কাটুক বাবা, বাঙালির ভ্যালেন্টাইনস ডে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.