প্রবন্ধ ১...
কেন কাশ্মীরের মানুষ এখানে পৌঁছলেন
রাজনীতিকে মন্দ অর্থে অনেক সময় ‘সম্ভাব্যতার শিল্প’ বলা হয় বটে, কিন্তু তার একটা বড় অর্থ তো এটাও যে, রাজনীতি বিপরীত পথের মানুষকেও এক জায়গায় আনার, একসঙ্গে পথ চলানোর এক ম্যাজিক রসায়ন, যার ভারসাম্যে সামান্য ফারাক হলেই গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাই অ্যালিসের আজব দেশের ‘হাম্পটি-ডাম্পটি’র মতোই ফেটে চৌচির হতে পারে! এটা ভারতের পক্ষে নিদারুণ সত্যি, কারণ, যুগ-যুগ ধরে এই বিশাল ভূখণ্ডে সমাজ-সংস্কৃতি-প্রথাভিত্তিক কিছু সাধারণ ঐক্যচিহ্ন জীবন্ত থাকলেও রাজনৈতিক ভাবে (অন্তত আধুনিক রাষ্ট্রভিত্তিক রাজনীতির ভিত্তিতে) তা এক ছিল না। আধুনিক রাষ্ট্রভিত্তিক রাজনীতির চল ভারতে অনেকটা শুরু হয়েছে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনে, যদিও তখনও ব্রিটিশ-ভারতের বাইরে থাকা দেশীয় রাজন্যবর্গ শাসিত ভারত, বা প্রান্তিক জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি অনেকখানি স্বাতন্ত্র্য ভোগ করত।
মুশকিল হল, স্বাধীনতার পর নতুন ভারত রাষ্ট্র এই সব স্বাতন্ত্র্যের অস্তিত্ব অবহেলা/অস্বীকার করে সবাইকেই তার আধুনিক একমাত্রিক চৌহদ্দির মধ্যে বাঁধতে চাইল। ফলে, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ভাষা নিয়ে, অঞ্চল নিয়ে, এমনকি ‘জাতিসত্তা’ নিয়ে ভারত জুড়ে এমন স্বাতন্ত্র্যকামী আন্দোলন শুরু হল, যা নেহরুর সময় থেকে এতাবৎ ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধাররা মেটাতে পারেননি। ফলে, উত্তর-মধ্য ও খানিকটা পশ্চিমাঞ্চলের ‘হিন্দি’ সংস্কৃতির সঙ্গে ‘অধিকাংশ’ ভারত, বিশেষত দক্ষিণের রাজ্যগুলো একাত্ম বোধ করে না, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির সাধারণ চর্চায় উত্তর-পূর্ব ব্যতীত অন্য অঞ্চলগুলিকে ‘মেনল্যান্ড ইন্ডিয়া’ বলা হয়, কাশ্মীরের মানুষ নির্দ্বিধায় ভারত সরকারকে বলে ‘দিল্লি কি সরকার’ বা হিন্দুস্তানের সরকার। এই মানসিক ভিন্নতা বোধ কি কেবল মেরে-পিটিয়ে, মিলিটারি দিয়ে বা আফস্পা-র মতো সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতার আইন মারফত মোকাবিলা করা যাবে? না কি, তার জন্য (অনাবশ্যক) অহং-ভোলা এমন এক রাজনীতি চর্চার প্রয়োজন ছিল, যার নজির প্রায় সাত দশকের ইতিহাসে অতি বিরল। উল্টে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির সঙ্গে এমন চাকরবাকরের মতো ব্যবহার করে এসেছে যে, ‘সমস্যা’ বিশেষত দেশের ‘সংবেদনশীল’ অংশগুলোয় আরও বেড়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারত যেমন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, কাশ্মীরও তেমনই।
স্মৃতি, সত্তা, ভবিষ্যৎ? গালিব। বাবার নাম আফজল গুরু। রাষ্ট্রপতির কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষার
আর্জি জানিয়ে বেরিয়ে আসছেন তাবাসুম। ৫ অক্টোবর, ২০০৬। গালিব তখন ৭, এত দিনে ১৪।
এটা ঠিক যে, কাশ্মীরের ভারতভুক্তি বিষয়ে নানা জটিলতা/ধন্দ আছে, সেখানকার মুসলিমদের একটা অংশ পাকিস্তানে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, ‘স্বাধীন’ কাশ্মীর রাষ্ট্রের প্রবক্তাও অনেকে ছিলেন, কিন্তু এটাও অনেক সময়েই খেয়াল থাকে না যে, জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান পরিষদে তাঁর দীর্ঘ প্রারম্ভিক ভাষণে (৫ নভেম্বর ১৯৫১) শেখ আবদুল্লা কাশ্মীর বিষয়ক তিনটি বিকল্পের— পাকিস্তানে যোগদান/ স্বাধীন কাশ্মীর গঠন/ ভারতে যোগদান— মধ্যে ভারতে যোগ দেওয়ার পক্ষে তীব্র ভাবে সওয়াল করেছিলেন। তা সত্ত্বেও বেশ কিছু মানুষ স্বাতন্ত্র্যের স্বপ্ন জাগিয়ে রেখেছিল, তার সঙ্গে পাকিস্তানের ‘ইন্ধন’, ভারত-পাক যুদ্ধের আবহ মিলে কাশ্মীর নানা সময়ে নানা প্রশ্নে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। তবুও, মোটের উপর তা আজকের মতো সরকারের শিরঃপীড়ার কারণ হয়নি। আজকের সমস্যার শুরুতে আছে আশির দশকের কেন্দ্রীয় প্রভুত্বের রাজনীতি— একের পর এক মনপসন্দ মুখ্যমন্ত্রীদের মসনদে বসানোর পুতুলখেলা।
১৯৪৮ সাল থেকে, প্রাথমিক ভাবে এই রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরেই কাশ্মীরের রাজনীতিতে স্বাতন্ত্র্যকামী মনোভাব এক নতুন পথে চলতে থাকে, যার সরকারি নাম ‘জঙ্গিবাদ’। সীমান্ত পেরনো মদত তো ছিলই, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙায়, আফগানিস্তানে তালিবান-সহ সোভিয়েত-বিরোধী ইসলামি যোদ্ধারা কাশ্মীরের ‘আজাদি’র লড়াইয়ে মদত দিতে শুরু করলে পরিস্থিতি ঘোরালো হতে শুরু করে। এই প্রেক্ষিতে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা তাঁদের ভিটেমাটি ছেড়ে জম্মুর সমতলে নেমে আসতে থাকেন। অন্য দিকে, এক পক্ষে জঙ্গি, অন্য পক্ষে তাদের মোকাবিলায় নিযুক্ত সুরক্ষা বাহিনীর দ্বৈরথে জীবন ওষ্ঠাগত হয়: সেনাবাহিনীর হাতে এমন বহু মানুষ প্রাণ হারান বা নির্যাতনের শিকার হন, যাঁদের সঙ্গে জঙ্গিপনার সম্পর্ক নেই। ফলে, স্বাতন্ত্র্যের মনোভাব সাধারণের মনেও জোরালো হয়, হিংসায় অর্থনীতি ও সমাজজীবন ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছলে যে মনোভাব খানিকটা শান্তি/স্বাভাবিকতা খোঁজে, ফের ভোট-ভিত্তিক রাজনীতির মধ্যেও বাঁচার আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু তা বলে স্বাতন্ত্র্যের মনোভাব কাশ্মীরে কখনওই শুকিয়ে যায়নি, নিয়মতান্ত্রিক স্বাভাবিকতার চাদরের তলায় তা, অন্তঃসলিলা, বইতে থাকে।
আফজল গুরুর ফাঁসির পর সেই ফল্গুধারা আবার বালি ফুঁড়ে বেরোতে চাইছে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে পি ডি পি নেত্রী মেহবুবা মুফতি যখন বলেন, ফাঁসি নয়, আফজলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়াই উচিত ছিল, সে কথা শুনে সাংবাদিক বলে বসেন, তার মানে তো মেনেই নেওয়া হচ্ছে, আফজল এক জন জঙ্গি, সেই জঙ্গিকে নিয়ে কাশ্মীরের মানুষের এত ভাবাবেগ কেন? কিন্তু এই প্রতিপ্রশ্ন তো এক গভীর সত্যকে চিনতে পারে না। সত্য এই যে, আইন/বেআইন, ন্যায়/অন্যায়ের ওপরে কাশ্মীরের বহু মানুষ এখন এক তীব্র আবেগে উদ্বেলিত। সে আবেগ সুরক্ষার বন্দুক বা উন্নয়নের শীতল যুক্তি, কিছুই মানছে না। এই আবেগ ‘জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের’, যার চোখে, বাদবাকি ভারতে ধিক্কৃত হলেও মকবুল বাট বা আফজল গুরু কাশ্মীরে ‘শহিদ’/হিরো। জাতি-স্বাতন্ত্র্যের এই আবেগী অবস্থান প্রায় সর্বজনীন। এই সত্য রাষ্ট্রেরও জানা। তাই বিক্ষোভ ছড়ানোর ভয়ে অনির্দিষ্ট কারফিউ বলবৎ করতে হয়, বৈদ্যুতিন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্তব্ধ রাখতে হয়, যা ভেঙে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ইতিমধ্যেই কয়েক জন মৃত।
কিন্তু এক বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিষ্ক্রিয় করে কি তাদের ‘সুনাগরিক’ বানানো যায়? মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ‘জঙ্গি’কে নিয়ে কাশ্মীরের মানুষের এত আবেগ কেন, কেন কাশ্মীরের মানুষকে এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়াতে হল, সেই প্রশ্ন বাদবাকি ভারত, বিশেষত ভারতীয় রাষ্ট্র নিজের কাছে পেশ করবে না? সে প্রশ্নের সৎ উত্তর দেওয়ার দায় স্বীকার করবে না সে? আসলে এখানেই প্রয়োজন, বড় রাজনীতি-র। যে রাজনীতি কেবল ভাগাভাগির ভোটে জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশের সমর্থন পেয়েও জোড়াতাপ্পির সরকার চালিয়ে কোনও মতে ক্ষমতা দখলের কৌশল নয়, যার আরও বড় মানে আছে। যে রাজনীতি রাষ্ট্রের মধ্যের নানা অংশের মধ্যে, এমনকি যারা ‘রাষ্ট্রের বাইরে’ যেতে চাইছে, তাদের সঙ্গেও প্রকৃত সংলাপ চালাতে দ্বিধা করে না। যে রাজনীতি ভোলে না, প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলিতে (যাদের নাম ‘পোলিস’, যা থেকে ‘পলিটিক্স’ কথার উৎপত্তি) ভাল রাজনীতির অপর নাম ছিল দ্বান্দ্বিক সংলাপ!

শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.