রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ ধর্মনায়ক পদত্যাগ করিতেছেন, এই ঘটনা ইতিহাসে বিরলের মধ্যে বিরলতম বলিলে ভুল হইবে না। প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে নানা অস্পষ্টতা আছে, তবে এ যাবৎ ২৬৫ জন স্বীকৃত পোপের মধ্যে যাঁহারা পদত্যাগ করিয়াছিলেন বলিয়া জানা যায়, তাঁহাদের সংখ্যা চার। শেষ পদত্যাগের ঘটনাটি ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দের, অর্থাৎ ৫৯৮ বছর পূর্বের। সুতরাং সোমবার ভ্যাটিকান সিটিতে পঁচাশি বছর বয়সি পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট যখন ঘোষণা করিলেন যে, শারীরিক অশক্ততার কারণে তিনি এই মাসের শেষ দিনটিতে সরিয়া দাঁড়াইবেন, তাহা ছিল আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক ঘোষণা। বিশ্বের একশো কোটির বেশি রোমান ক্যাথলিকের ধর্মনেতার স্বেচ্ছা-অবসর স্বতঃই তাৎপর্যপূর্ণ। তাহার উপর, পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের আট বছরের জমানাটি ছিল রীতিমত বিতর্কিত। স্বয়ং পোপ সহ বহু যাজকের নামে শিশুদের উপর যৌন-নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত থাকিবার বা প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠিয়াছে। গর্ভপাত ও জন্মনিরোধক ব্যবহারের প্রশ্নে তাঁহার নেতৃত্বাধীন চার্চের অনড় অবস্থান প্রবল সমালোচনা ডাকিয়া আনিয়াছে। ইসলামের আধিপত্য বিস্তার সম্পর্কে তাঁহার অ-সংবেদী ‘চেতাবনি’ আলোড়ন তুলিয়াছে।
কিন্তু এই সব প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে যে মূল সমস্যাটি গত এক দশকে প্রবল আকার ধারণ করিয়াছে তাহা, এক কথায়, চার্চের ভবিষ্যৎ। ইউরোপের আদিভূমিতে নূতন প্রজন্মের মধ্যে ধর্মাচরণের আকর্ষণ কমিতেছে, দুনিয়ার রোমান ক্যাথলিকদের মাত্র সিকিভাগ এখন ইউরোপের বাসিন্দা। সংখ্যার বিচারে লাতিন আমেরিকাই এই ধর্মের প্রধান ক্ষেত্র, কিন্তু সেখানেও প্রোটেস্টান্ট ও অন্যান্য ধারার খ্রিস্টধর্মের প্রভাব বাড়িতেছে। কী ভাবে ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ ধর্মের ভুবনে আপন গুরুত্ব ফিরাইয়া আনিতে পারে, তাহা ভ্যাটিকান সিটির সামনে বড় প্রশ্ন। পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টও তাঁহার ‘বিদায় ভাষণ’-এ এই গুরুদায়িত্বের কথা পরোক্ষে স্বীকার করিয়াছেন। যথাযথ দায়িত্ব পালনের জন্য যে সামর্থ্যের প্রয়োজন, তাহা আর তাঁহার নাই, সুতরাং পদত্যাগ।
ইহাই প্রকৃত কারণ, না কি শরীরে দোহাই দিয়া পোপ তাঁহার বিতর্কিত এবং সমস্যাসঙ্কুল পদটি ছাড়িলেন, তাহা লইয়া হয়তো জল্পনার অবকাশ আছে। কিন্তু এই ঘটনা হইতে ভারতীয় নায়কদের শিখিবার আছে। কী ধর্ম, কী রাজনীতি, কী সমাজের অন্য নানা ক্ষেত্র, সর্বত্রই এ দেশে বৃদ্ধতন্ত্রের অবিরত আধিপত্য। ক্ষমতার আসনই যেন বার্ধক্যের বারাণসী। বয়স বেশি মানেই জ্ঞান বেশি এই সম্পূর্ণ অপ্রমাণিত ধারণার দোহাই দিয়া ভারতে প্রবীণরা সর্ব ক্ষেত্রে শাসন করিয়া চলেন, তরুণরাও মোটের উপর সেই শাসন মানিয়া লন, কারণ এই ধারণাই সমাজের মনোভূমিতে প্রোথিত। ফলে নূতন চিন্তার উন্মেষ ঘটে না, নূতন পথের দ্বার খোলে না। রোমান ক্যাথলিক চার্চও কম ‘সনাতনপন্থী’ নহে। সেই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ অধিপতি দেখাইলেন, তিনি থামিতে জানেন। ভারতের ক্ষমতাবান প্রবীণরা পারিবেন কি? |