সম্পাদকীয় ১...
গুন্ডারাজধর্ম
শ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাণী দিয়াছেন, ‘গণতন্ত্র মানে পুলিশকে গুলি করে মেরে ফেলা নয়।’ দিনের বাণী হিসাবে অতি উৎকৃষ্ট। আশা করা যায়, তাঁহার অনুগামী তথা অনুগতরা অতঃপর প্রত্যহ ঘুম হইতে উঠিয়া একমনে দশ বার এই বাণী জপ করিবেন এবং এতদ্দ্বারা গণতন্ত্রের নিগূঢ় অর্থটি হৃদয়ঙ্গম করিবেন। কেবল আব্রাহাম লিঙ্কন নয়, গণতন্ত্রের বহু সংজ্ঞা বহু জনে সরবরাহ করিয়াছেন, কিন্তু বোঝা গেল, এমন একটি চমৎকারী ব্যাখ্যার জন্য মা-মাটি-মানুষের সহজিয়া প্রজ্ঞার প্রয়োজন হয়। সূক্ষ্ম বিচারে অবশ্য মমতাদেবীর উচ্চারিত বাক্যটি ঈষৎ উদ্বেগজনক। গণতন্ত্র মানে পুলিশকে গুলি করিয়া মারিয়া ফেলা নয় তবে কি গণতন্ত্রে পুলিশকে আর সব কিছুই করা চলে, কেবল গুলি না করিলেই হইল? না কি, গুলিও তন্ত্রমতে বিহিত, কেবল দেখিতে হইবে যেন পুলিশের প্রাণ না যায়?
পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনে এবংবিধ সংশয় বিশেষত স্বাভাবিক, কারণ তাঁহারা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখিয়াছেন যে, ক্ষমতার আসনে যাঁহারা অধিষ্ঠিত থাকেন তাঁহারা পুলিশকে লইয়া বাস্তবিকই যাহা চাহেন তাহাই করিতে পারেন, গণতন্ত্র তাঁহাদের করকমলে সেই যথা-ইচ্ছা-আচারের অধিকার তুলিয়া দিয়াছে। এই যথেচ্ছাচারের ধারাটি পরম যত্নে এবং চরম দক্ষতায় লালন করিয়াছিল ভূতপূর্ব বামফ্রন্ট সরকার, বিশেষত তাহার প্রধান শরিক সি পি আই এম। প্রশাসন এবং পুলিশের উপর পার্টির নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সর্বময় কর্তৃত্বে বিশ্বাসী একটি দলের নায়করা যে ভাবে পাঠশালা হইতে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি সমগ্র শিক্ষাজগৎকে দখল করিয়াছিলেন, ঠিক সেই ভাবেই স্থানীয় ফাঁড়ি হইতে পুলিশের সদর দফতর অবধি সর্বস্তরে দলীয় সাম্রাজ্য বিস্তৃত হইয়াছিল। পার্টির নির্দেশ বা অনুমতি ব্যতীত পুলিশ দুষ্কৃতীদের ধরিতে পারিত না, ধরিলেও উপরমহল হইতে হুকুম আসিলে ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইত। প্রশাসন এই ভাবেই তাহার মেরুদণ্ড হারাইয়াছিল, দক্ষতাও।
সেই গণতন্ত্র সমানে চলিতেছে। শাসক বদলাইয়াছে, শাসক দলের কাঠামো এবং আচরণ-পদ্ধতি বদলাইয়াছে। আলিমুদ্দিনের দখলদারি দক্ষতা অনেক স্তালিনের সাধনার ফল, তাহা তৃণমূল কংগ্রেসের সাধ্যাতীত। কিন্তু প্রশাসনের উপর দলীয় প্রভুত্বের মূল আকাঙ্ক্ষার অবসান হইয়াছে, এমন কথা মনে করিবার কোনও কারণ ঘটে নাই। বারংবার বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গিয়াছে, পুলিশ দুষ্কৃতীদের দমনে প্রত্যাশিত নিরপেক্ষতা এবং তৎপরতা দেখাইতে অক্ষম, যদি বা তাহা দেখায়, দলনেতারা কুপিত হইলে পুলিশের উপর ‘শাস্তি’র কোপ নামিয়া আসে। কখনও পুলিশের কর্তা বা কর্মীরা তিরস্কৃত, কখনও বদলি হন। তাহার সহিত এই জমানায় যুক্ত হইয়াছে আর একটি ভয়ানক ব্যাধি। যে কোনও ঘটনা ঘটিলে তাহার তদন্তের সূচনা হইবার আগেই মুখ্যমন্ত্রী হইতে শুরু করিয়া সরকারি তথা দলীয় কর্তারা ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কে তাঁহাদের সিদ্ধান্ত জানাইয়া দেন, কোনটি ‘সাজানো ঘটনা’, কোন অপরাধের জন্য কে দায়ী, কোন দুর্বৃত্তরা ‘ছোট ছোট ছেলে’, কোন ছেলেই বা ‘তাজা’, সবই তাঁহারা জানেন এবং ঘোষণা করেন। ইহাতে পুলিশের মনোবলের উপর কী প্রভাব পড়িল না পড়িল, তাহা ভাবিবার দায় তাঁহাদের নাই, কারণ পুলিশকে লইয়া যাহা খুশি করিবার গণতান্ত্রিক অধিকার তাঁহাদের করায়ত্ত।
এই পরিস্থিতির পরিণাম যাহা হইবার তাহাই হইতেছে। কঠোর এবং নিরপেক্ষ তৎপরতায় দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করা এবং আটক করার সাহস পুলিশ বহু ক্ষেত্রেই হারাইয়া ফেলিতেছে, হয়তো তাহার ইচ্ছাও। মঙ্গলবারের ঘটনায় জড়িত দুষ্কৃতী-বাহিনী এবং তাহাদের দলীয় দাদা ও গুরুদের খবর পুলিশ-প্রশাসন জানিত না, এ কথা বিশ্বাস করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু গুন্ডাদের মুখ চাহিয়া যদি রাজ্যপাট চালাইতে হয়, তবে সেই খবর জানিয়াই বা কী লাভ? পুলিশকর্মী তাপস চৌধুরীর মর্মান্তিক মৃত্যু এই রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণগ্রস্ত শাসন-কাঠামোটির সংস্কার করিতে পারিবে, এমন ভরসা পশ্চিমবঙ্গবাসীর নাই। গুন্ডারাজ এবং রাজধর্ম একত্র থাকিতে পারে না। গণতন্ত্রের নূতন ভাষ্যকার মুখ্যমন্ত্রীকে বাছিয়া লইতে হইবে, তিনি কোনটি চাহেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.