|
|
|
|
মুঙ্গেরি জোগানে জোয়ার, বন্দরে বন্দুক-রাজ |
শুভাশিস ঘটক |
বন্দুক যেন হাতের মোয়া! বিশেষত গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ-সহ তামাম বন্দর অঞ্চলে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, মুঙ্গেরি অস্ত্রের বিশাল বাজার এখন বন্দর এলাকা। যার সুবাদে এই তল্লাটে সমাজবিরোধীদের হাতে-হাতে ঘুরছে ওয়ান শটার থেকে অত্যাধুনিক নাইন এমএমের মতো বিবিধ অস্ত্র। মওকা বুঝে যার প্রয়োগও হচ্ছে হামেশা।
যেমন হল মঙ্গলবার। ওয়ান শটারের থ্রিনটথ্রি কার্তুজ এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে দিল কলকাতা পুলিশের এসআই তাপস চৌধুরীর বুক। যার হাত থেকে বন্দুক গর্জাল বলে অভিযোগ, গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, তেমন মামুলি চেহারার আরও বেশ কিছু অস্ত্রধারী ভিড়ে মিশে ছিল। যুতসই ইন্ধন পেলে তারাও পিছপা হয়ে থাকত না। এবং সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারত বলে পুলিশের একাংশের অনুমান। বস্তুত বন্দর এলাকা যে অবৈধ অস্ত্রের আড়ত হয়ে উঠেছে, খোদ সরকারি তরফেই তা কার্যত মেনে নেওয়া হচ্ছে। রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী তথা বন্দরের তৃণমূল বিধায়ক ফিরহাদ হাকিম বুধবার মহাকরণে বলেন, “গার্ডেনরিচে প্রচুর বেআইনি অস্ত্র আছে। সেগুলোকে উদ্ধার করতে বলা হয়েছে।”
কলকাতার বন্দর তল্লাটে আগ্নেয়াস্ত্রের এ হেন রমরমার পিছনে সেই আদি ও অকৃত্রিম মুঙ্গেরি-যোগ দেখছে পুলিশ। রাজ্য গোয়েন্দা-পুলিশের এক কর্তার কথায়, “গত দেড় বছরে প্রায় শতাধিক অস্ত্র কারবারীকে ধরা হয়েছে।” সূত্রের খবর: গত ক’মাসে এ রাজ্যে মুঙ্গেরি হাতিয়ারের আমদানি চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। আর এর মধ্যে বন্দর এলাকায় অস্ত্র চালান বেড়েছে প্রায় ছ’-সাত গুণ। জানা গিয়েছে, অস্ত্রের চালান আনতে কলকাতা-মুঙ্গের-কলকাতা এবং চালান পৌঁছাতে মুঙ্গের-কলকাতা-মুঙ্গের ‘রুটে’ ‘ক্যুরিয়র’দের আনাগোনা বেড়েছে অনেক বেশি। “দু’সপ্তাহে এক বারের জায়গায় অনেক ক্ষেত্রে ছ’-সাত বার পর্যন্ত চালান আসছে।” জানাচ্ছে এক সূত্র।
শুধু তা-ই নয়, খদ্দের বা গ্রাহকদের সুবিধার দিকেও বিলক্ষণ নজর রাখছে মুঙ্গেরি কারবারিরা। কার্তুজ ছাড়া বন্দুক অকেজো, তাই বুলেটের ‘বিপণনে’ শহরের কোথাও কোথাও কার্যত ফ্র্যাঞ্চাইজি খুলে ফেলেছে তারা। এক সূত্রের কথায়, “চিনা নাইন এমএম পিস্তলের বুলেটভর্তি ম্যাগাজিন পাওয়াটা একটু কঠিন। ঠিক এই জায়গায় মুঙ্গের চিনকে কিছুটা মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে। মুঙ্গেরি নাইন এমএমের খদ্দেরকে কার্তুজের জন্য হা-পিত্যেশ করে থাকতে হচ্ছে না।” এক গোয়েন্দা-কর্তা জানাচ্ছেন, এখন মুঙ্গেরি যে সব ওয়ান শটার আসছে, তার মধ্যে যথেষ্ট উদ্ভাবনী শক্তির ছাপ। “আগের ওয়ান শটারের চেয়ে এর মাথাটা একটু লম্বা। তাতে রেঞ্জ বেড়ে গিয়েছে। দাম পড়ছে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। কার্তুজের দাম চারশো-সাড়ে চারশো।” বলেন তিনি। হাজার কুড়ি টাকা ফেললে মুঙ্গেরে তৈরি ইমপ্রোভাইজড নাইন এমএম, সেভেন এমএম-ও সহজলভ্য।
এমন ফলাও কারবার চলছে কী ভাবে? পুলিশ-সূত্রের খবর: ধরা পড়া মুঙ্গেরি অস্ত্রের কিছু এজেন্টকে জেরা করে জানা গিয়েছে, গত ক’মাস যাবৎ এ রাজ্যে সব রকম অস্ত্র ঢালাও বিকোচ্ছে। গত এক বছরে তারা ব্যবসা করেছে প্রায় দেড় কোটি টাকার, আগে যা তিরিশ লাখও পেরোত না। মুঙ্গেরের কারবারিরা কিছু ক্ষেত্রে এ রাজ্যে সরাসরি এজেন্ট নিয়োগ করেছে। অস্ত্র আসছে মূলত রেলপথে, বর্ধমান-ব্যান্ডেল-ডানকুনি হয়ে। বিভিন্ন স্টেশনে খালাস হওয়া ‘মাল’ সড়কপথে পৌঁছে যাচ্ছে কলকাতা-সহ শহরে শহরে। এমনকী, ব্যবসার বহর এত বেড়েছে যে, কিছু স্টেশন থেকে মাসিক চুক্তিতে গাড়ি-ভাড়া করা হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন এক গোয়েন্দা।
তা হলে পুলিশি নজরদারির কী হল? এ প্রশ্নের সদুত্তর কারও কাছে মেলেনি। যদিও পুলিশ-কর্তাদের একাংশ একান্ত আলাপচারিতায় পরিকাঠামো ও লোকবলের অভাবের পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপের কথাও বলছেন। বন্দর এলাকার এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা নিজেও বলছেন, “মুঙ্গের থেকে এত বিভিন্ন রকমের অস্ত্র এখানে ঢুকছে যে, কোনও হিসেব নেই!” রাজ্য পুলিশের এক কর্তর আশঙ্কা, “পুলিশের চেয়ে দুষ্কৃতীর হাতে এখন অস্ত্র বেশি। এলাকায় এলাকায় অস্ত্রাগার তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এনকাউন্টার হলে ওরাই অ্যাডভান্টেজ পাবে!”
যা শুনে সিআইডি-র এক অফিসারের টিপ্পনি, “এ জন্যই এখন পুলিশের হাত গুটিয়ে থাকাটা মঙ্গল।’’ |
|
|
|
|
|